Friday, July 8, 2016

দ্বীনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা

নিশ্চয় আল্লাহতাআলা সুন্দর, সুন্দরকে ভালবাসেন

আল্লাহতাআলা দ্বীন দিয়েছেন যেন আমাদের জীবন সুন্দর হয়। আর জীবন সুন্দর মানে জীবনে যা কিছু করা হয়, ভাবা হয়, অন্তর-বাহির সবগুলোই সুন্দর। বাহিরও, ভিতরও।

اللَّهُمَّ اجْعَلْ سَرِيرَتِي خَيْرًا مِنْ عَلاَنِيَتِي وَاجْعَلْ عَلاَنِيَتِي صَالِحَةً
হে আল্লাহ, তুমি আমার গোপনকে আমার প্রকাশ্যের চেয়ে বেশি ভাল কর, আর প্রকাশ্যকেও ভাল কর

কিন্তু অন্তর, ঐটার গুরুত্ব প্রকাশ্যের চেয়ে আরও বেশি। আর এটা তো বিভিন্নভাবেই পাওয়া যায়।  إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّةِ এই কথা বলা হয়নি যে إِنَّمَا الأَنِّيَّةِ بِالعْمَالُ আমল দিয়ে ভাল নিয়্যতের বিচার করা হবে – তা নয়। বরং নিয়্যত দিয়ে আমল বিচার করা হবে। নিয়্যত যদি ভাল হয় তাহলে আমল ভাল, নিয়্যাত খারাপ হলে আমল খারাপ। তো উল্টোটা হবে না। আমল যদি ভাল হয় তাহলে নিয়্যাত ভাল – এমনটা হবে না। আর আমল খারাপ হলে নিয়্যাত খারাপ – তাও হবে না। প্রাধান্য নিয়্যাতেরই, যেটা দেখা যায় না। যেটা গোপন, ভিতরে আছে।
তো সব আমলের মধ্যে এই শুদ্ধতার সৌন্দর্য থাকা জরুরী। ঠিকমত করতে পারছে না যে শর্ত আছে সৌন্দর্যের, শুদ্ধতার, তো সেই ক্ষেত্রে কখনো কখনো আমল হয়ত এত বেশি জরুরী যে বাদ দেওয়া যাবে না, আবার মাত্রা আছে এমন যে কোন ক্ষেত্রে ঐ আমল না করাই ভাল যদি ঠিকমত না করতে পারে।
নামায সবচেয়ে বড় আমল। ভাল করে যদি না পড়ে তাহলে পুরনো কাপড়ের মত ছুড়ে ফেলে দেওয়া হবে। কিন্তু তার মানে এইটা নয় যে ভাল করে যদি না পড়ি, তাহলে না পড়াই ভাল। পড়তে হবে তবুও। তো ছুড়ে ফেলে দেওয়ার কি মানে? আল্লাহতাআলা বেহতার জানেন। ওলামারা হয়ত অনেক কিছু বলতে পারবেন। এটাও তার একটা অর্থ হতে পারে যে এই নামাযের দ্বারা তার যে ফায়দা হওয়ার কথা ছিল, প্রত্যাশিত ফায়দা – ঐটা হবে না। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে নামায আদায় হয়ে গেল। আর নামায না পড়ার যে গুনাহ, সেটা থেকেও বেঁচে গেল। কিন্তু নামাযের দ্বারা তার বিভিন্ন ফায়দার মধ্যেও এটাও এক ফায়দা যে তার জীবন শুদ্ধ হবে, সুন্দর হবে, তার ঈমানী আমালে তরক্কী হবে, আখলাকিয়্যাতের তরক্কী হবে। যদিও প্রত্যেক মুহুর্তে এটা বুঝা যাবে না। পুকুরে যদি এক বদনা পানি ঢালে, তাহলে পুকুরের পানির লেভেল নিশ্চয় বেড়েছে। যদিও সাধারণ মাপে ধরা পড়ে না। তো ওরকম নামায পড়লে তার একটা তরক্কী হওয়ার কথা, ঐ তরক্কী হবে না, কিন্তু নামায তবুও আদায় হল। কিন্তু এই একই নিয়ম সব জায়গায় প্রযোজ্য নয়।
কোন একজন ওলীআল্লাহ তার ছেলেসহ সফরে ছিলেন। মাঝখানে রাত্রে সরাইখানায় থেমেছেন। তাহাজ্জুদের জন্য উঠেছেন, সাথে উনার ছেলেও উঠেছে। মুসাফিররা ঘুমাচ্ছে। ছেলে এই মুসাফিরদের দিকে তাকিয়ে বলল যে ‘কিরকম গাফেলের মত ঘুমাচ্ছে এরা, তাহাজ্জুদের জন্য উঠল না’। বাপ একজন ওলীআল্লাহ ছিলেন। তো বাপ তাকে বললেন যে ‘বাবা, তোমার এর চেয়ে ঘুমিয়ে থাকাই ভাল ছিল’। অন্যের প্রতি তাচ্ছিল্য এনে আর তাহাজ্জুদ পড়ে তুমি যেটা পেলে, হারাচ্ছো তার চেয়ে বেশি। তার চেয়ে তুমিও ঘুমিয়ে থাকতে। ঐটাই তোমার জন্য লাভজনক বেশি ছিল। কিন্তু এটা ফারায়েযের ব্যাপারে বলা যাবে না। ফযরের নামায পড়ছে না আর বলল যে ‘ঘুমাচ্ছে’; যদিও তাচ্ছিল্য তখনো আনা উচিত নয়, কিন্তু এই কথা বলা যাবে না যে তোমার ফযরের নামায না পড়াই বরং ভাল ছিল। তাহাজ্জুদের ব্যাপারে যদিও বলা যাবে।
রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুয়ায ইবনে জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহুকে দু’আ শিখিয়েছেন
للهم أعني على ذكرك وشكرك، وحسن عبادتك
তোমার যিকির, তোমার শোকরের তৌফিক দাও আর ইবাদত যেন সুন্দরভাবে করতে পারি
তো সব কাজ যেন সুন্দর হয়
فَيَنظُرَ كَيْفَ تَعْمَلُون
আল্লাহতাআলা দেখতে চান যে তুমি আমল কেমন করে কর।
আর অন্যান্য আয়াতের মধ্যে একই অর্থ আছে। أَحْسَنُ عَمَلًا বলা হয়েছে। اَخْسَرُعَمَلًا বলা হয়নি। সুন্দর আমল।
لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا
তোমাদের মধ্যে কার আমল বেশি সুন্দর হুসুন, আহসান বেশি সুন্দর।
বেশি করা হয় যেটা বড় বড় ওলীআল্লাদের ক্ষেত্রে পাওয়া যায় যে এত শত রাকাত, এত হাজার রাকাত নামায পড়তেন, তো তারা কি এই আয়াত বুঝলেন না। (আসলে) বেশির জন্য পড়তেন না, সুন্দর পর্যন্ত যাওয়ার জন্য পড়তেন।
ছেলেকে বলা হল যে একশোবার লিখ ‘সদা সত্য কথা বলিব’। প্রথম কথা হল মাষ্টারও নিয়্যত করেনি, ছাত্রও নিয়্যত করেনি সত্য কথা বলার আর সত্য কথা বলার জন্য সে লিখছেও না। লিখছে হাতের লিখা সুন্দর করবার জন্যে। তো বলল যে পাঁচশবার লিখতে হবে। পাঁচশবার যে লিখছে ঠিকই, পাঁচশবারের জন্য নয়, বরং পাঁচশতম যেটা ঐটার জন্যে। পাঁচশবার লিখার পরে সবশেষ লাইন যেটা, ঐটা গিয়ে সুন্দর হবে। কিন্তু ঐ সুন্দরের জন্যে এর আগে চারশ নিরানব্বই বার দরকার। কেউ যদি বলে যে তাহলে শুধু ঐটাই লিখি আর আগের চারশ নিরানব্বই বার লিখার কি দরকার। না, তা হবে না।
তো একজন তার খুব শখ যে সে সাহিত্যিক হবে, গল্প বই লিখবে। আর বড় বড় লেখকদের নির্বাচিত লিখাও থাকে। তো সে ভাবল যে প্রথমেই আমার নির্বাচিত গল্পগুলো লিখে ফেলি, বাকীগুলো পরে সুযোগ হলে লিখা যাবে। তো সংখ্যার বেশি দরকার, কিন্তু আসলেই একটাই, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ঐ সংখ্যা ছাড়া ঐ একটা হয় না। বাপের সাথে ছেলে ঘোড়দৌড় দেখতে গেছে। বাপ বুঝালো যে একটা ঘোড়া ফার্স্ট হবে, যেটা ফার্স্ট হবে সেটা অনেক টাকা পাবে। অনেকগুলো ছিল ঘোড়া। তো ছেলে বলল যে তাহলে একটা যদি ফার্স্ট হবে তাহলে বাকীগুলো কেন খামোকা দৌড়াচ্ছে। ঐ একটা রাখলেই হয়।
তো আল্লাহতাআলা সুন্দর চান সুন্দরের জন্যে, ওসীলা হিসেবে কখনো বেশির দিকে যেতে হয়। কিন্তু আসলে লক্ষ্য সুন্দর। সুন্দর, শুদ্ধ আমল যেন হয়। সব আমলে মধ্যে এইটাই আল্লাহতাআলা দেখবেন ‘فَيَنظُرَ كَيْفَ تَعْمَلُون’। তুমি কেমন করে করলে। আল্লাহতাআলা আমাদেরকে দ্বীনের মেহনত দিয়েছেন। এই দ্বীনের মেহনতকেও সুন্দরভাবে করা। উম্মতের প্রত্যেক ব্যাক্তিকে গোটা মানবজাতির জন্যে পাঠিয়েছেন। মানবজাতির উপকারের জন্যে। উপকার মানে তার শুভকামী হতে হবে। প্রত্যেক ব্যাক্তির শুভকামী। এর মোকাবিলায় অন্যের অমঙ্গলে আনন্দ পাওয়া – এটা আল্লাহতাআলার কাছে চুড়ান্ত মাত্রার অপছন্দের জিনিস। যেখানে আল্লাহতাআলা পাঠিয়েছেন মানুষের শুভকামী হওয়ার জন্যে, সেখানে তার ক্ষতিতে আনন্দিত হওয়া – একেবারে আল্লাহর সৃষ্টির লক্ষ্যের বিরুদ্ধে হল ব্যাপারটা। এইজন্যে কেউ যদি একটু চিন্তাও করে তো বুঝতে পারবে যে গীবত কত খারাপ জিনিস। আর গীবতের বিরুদ্ধে এতগুলো কথা এসেছে – তো খুব যুক্তিসঙ্গত। কারণ আল্লাহতাআলা মানুষকে যে উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছেন, মানুষের শুভকামী হওয়া। অথচ গীবত মানে হল অন্যের কোন অমঙ্গলে আনন্দবোধ করা।
আড়ালে কারও দোষের আলোচনা করা – শুধু এইটুকুতে গীবত হয় না। অনেক ক্ষেত্রে তার আড়ালে তার কোন দোষের আলোচনা করা ফরয পর্যন্ত হয়। কখনো ফরয হয়, কখনো ওয়াজীব হয়, কখনো সুন্নাত হয়, কখনো মুস্তাহাব হয় ক্ষেত্রবিশেষে। বিভিন্ন ধরনের।
ক্যান্সার রোগী। ডাক্তার তার পরিবারের লোককে আলাদা করে, রোগীর সামনে নয়, ডায়াগনসিসের রিপোর্ট দিল যে রিপোর্ট তো খারাপ, এটা ম্যানিক ডেথ, ক্যান্সার ধরা পড়েছে। তো এই যে ডাক্তার তার আড়ালে বাপ বা ছেলেকে বলল, তো সেই ডাক্তার কি গীবতের গুনাহয় গুনাহগার হবে নাকি। তাহলে গীবত কি? কারো অনুপস্থিতে এমন কোন কথা বলা যে শুনতে পছন্দ করবে না। এটা তো পুরোপুরি সঙ্গার মধ্যে পড়ে। তার উপস্থিতিতে যদি বলে তোমার ক্যান্সার হয়েছে, সে পছন্দ করবে না। তো এমন কথা তার আড়ালে বলা হল, সামনে বললে অসন্তুষ্ট হত। সঙ্গা অনুযায়ী গীবতই তো হল। গীবতের পুরোপুরি ডেফিনেসনের মধ্যে পড়ল। কিন্তু শরীয়তের যেটাকে গীবত বলে, যেটাকে নিষিদ্ধ করা হয়, এটা ঐটার মধ্যে পড়ে না। ওকে আড়ালে করা, আড়ালে বলা তার সাথে শত্রুতা করে নয়, বরং তাকে অতিরিক্ত কষ্ট থেকে বাঁচাবার জন্য। শুনলে তার খারাপ লাগবে, অথচ তার পরিবারকে জানানোর প্রয়োজন। তো সেজন্য ওর যাতে খারাপ না লাগে, এজন্য এটা করল। তার হয়ত খারাপ লাগবে, কিন্তু অন্যের হুকুমের মধ্যে পড়ে।
হাসান বসরী রহঃ এর কথা ‘তোমরা কি ফাযিরদের আলোচনা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখ নাকি? আত তারা গাইবুনা আন যিকরি ফাযির এই জাতীয়। ফাযিরদের আলোচনা থেকে তুমি বেঁচে থাকতে চাও – এটাকে দোষারোপ করেছেন। নিশ্চয় ফাযিরদের আলোচনা কর, মানুষকে সাবধান করে দাও। শুনে আমরা বলব যে বড় আজীব কথা। এরকম কথাতো কোনদিন শুনিনি। অথচ আমাদের সমাজে এই কথার উপরে আমল বহুত ব্যাপক।
ওলামারা প্রায় বিদআতীদের আলোচনা করেন। আর তাকে সামনে রেখে যে করছেন তাও নয়। আটরশির আলোচনা করে, মাইজভান্ডারীর আলোচনা করে, কুতুববাগীর আলোচনা করেন আর এই আলোচনাগুলো তাদের শরয়ী-দ্বীনি দায়িত্ব হিসেবে করেন। অতএব হাসান বসরী রহঃ এর হুবহু এই কথার সাথে আমরা পরিচিত হতে নাও পারি, কিন্তু এর অর্থের সাথে পরিচিত। আর ওলামারা বিশেষ করে এটার উপর আমলও করে থাকেন। এদের এই খারাপের আলোচনা কেন করছেন? আলোচনা এইজন্য করছেন যে মানুষকে সাবধান করে দাও। কখনো কখনো আলোচনার ধরনের মধ্যে কিছু রসও থাকে। রস থাকে হয়ত মানুষকে বুঝাবার জন্যে বা মানুষের নযর কাড়ার জন্যে। বাকী ওর দোষের জন্যে যে আনন্দবোধ করা – ঐটা জায়েয নাই। আমাদের দেশের খুব উল্লেখযোগ্য আলিম, উনার ওয়াজ শুনছিলাম। উনার কোন অঞ্চলের মধ্যে কার যেন কথা বলছিলেন ‘ন্যাংটা পীর’। কাপড়-চোপড় নাই, উলঙ্গ বসে আছে আর লোকে বলে যে এর মধ্যেও কিছু না কিছু তো আছেই। উনি বলেন, ‘হ্যা,কিছু তো আছেই, দেখাই যাচ্ছে’।
তো আলোচনা করছেন আর এটা করা জরুরী বলে করছেন। আর ঐ যে বললাম – স্তর নির্ভর করে। কখনো কখনো ফরযও হতে পারে, কখনো কখনো এর চেয়ে কম হয় মানে সাবধান করে দেওয়া। কিন্তু সবগুলোর মধ্যে নানান সুরুত আছে।
আমার বাপ বিদাতী পীর। আমি শুদ্ধ আক্বিদার আর আমি জানি উনি বিদাতী এবং উনার কাছে লোকজন গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমার দায়িত্ব হবে মানুষকে সাবধান করে দেওয়া যে আমার বাপের কাছে গিয়ে মুরীদ হবে না। প্রয়োজনে যদি তাকে বুঝাতে হয়, তো বাপের অনেকগুলো দোষের চর্চাও করতে হবে। কে বলল ‘কেন, উনি তো ভালই’। ছেলে বলল ‘না, ভাল না’। হয়ত ‘না,ভাল না’ শুধু বলাতে তার ইতমিনান হল না। তখন আরও খুলে বলতে হবে যেগুলো আমি জানি যাতে উনার থেকে তার আক্বিদা সরে। কিন্তু এই যে আমি আমার বাপের দোষের কথা বলছি, এই বলা আমার জন্য কোন আনন্দের নয়। ঠেকাই পড়ে বলছি। বাপ হিসেবে উনার অপমান, এটা আমার অপমান। এই বোধ আমার আছে। তো এই বোধ বজায় রেখে তার দোষের চর্চা করছি আর এই দোষের চর্চার জন্য সওয়াব পাব। আর এই বোধ থাকার কারণে আমি যে কষ্ট পাচ্ছি, এই কষ্টেরও সওয়াব পাবো। কিন্তু যদি আমার এই বোধ না থাকে আর এই দোষ চর্চাগুলো যদি আনন্দের সাথে করি, লোকে যখন গীবত করে বেশ ফুর্তি করে, মজা করেই করে – তাহলে সে একজন বেহায়া। আর আল্লাহতাআলা এইজন্য বেহায়া লোককে পছন্দ করেন না। আর ছেলে হিসেবে ওর বাপের ওর উপর যে হক্ব আছে, এই হক্বও সে আদায় করেনি। ওর লজ্জা পাওয়া আর এই কথাগুলো বলতে ভাল না লাগা – এটা ওর বাপ হিসেবে তার উপর হক্ব। আর ওর যে খারাপ লাগল না, লজ্জাও পেল না – এতে ওর বাপেরও হক্ব আদায় করল না, আর একজন মানুষে হিসেবে মানুষের বড় একটা বৈশিষ্ট্য যে হায়া থাকা, ঐ বৈশিষ্ট্য প্রকাশেও সে ব্যার্থ হল। বেহায়া।
তো বলতেও হবে যাতে মানুষ ভুল থেকে বেঁচে যায়, কিন্তু ছেলে হিসেবে তার প্রতি যে ভালবাসা – এইটাও রাখতে হবে। বাপ ভন্ড তাই বলে ও আমার বাপ নয় – এই কথা ঠিক নয়। বাপ তবুও। আর বাপ বলে ও ভন্ড নয় – এই কথাও ঠিক নয়। ও যদি ভন্ড হয় তাহলে আমার বাপ হওয়া স্বত্ত্বেও ভন্ড। একটা আরেকটাকে বাতিল করবে না। যেহেতু আমার বাপ, অতএব উনি হক্ব পীর – এইকথা যেমন ঠিক নয়, আর যেহেতু উনি ভন্ড, অতএব উনি আমার বাপই নয় – এই কথাও ঠিক নয়। সবটা তার নিজস্ব সীমানার মধ্যে রাখতে হবে। ভন্ড এই কথাও ঠিক, প্রয়োজন যেখানে বলতে হবে; এই কথাও ঠিক। যদি প্রয়োজন হয় তো মাইক লাগিয়ে বলতে হবে। গোটা গ্রামের লোককে জানাতে হবে। যদি আমি ইচ্ছাকৃত না জানাই, তাহলে ওদের হক্ব নষ্ট করলাম। ঠিক যেরকম একজন অন্ধ ব্যাক্তি আমার চোখের সামনে গর্তের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে আর আমি তাকে বাধা দিলাম না। তো সর্বঅর্থে এই যে দাঁড়িয়ে থাকল, দেখল আর বাধা দিল না, সে দোষী হবে। এইকথা বললে হবে না যে আমি তো কিছুই করিনি। ঐ কিছু না করাটাই ওর দোষ।
ওলামারা যে বিদাতীদের ব্যাপারে ওয়াজ করেন, বই লিখেন; এগুলো না করলে তারা দায়ী হবেন। কিন্তু এর মধ্যে কোন আনন্দ না পাওয়া। ঠেকা তাই করতে হচ্ছে।
একজন অভাবে পড়ে ক্ষুধায় মরার উপক্রম প্রায়। জান বাঁচাবার জন্য পেল শুধু শুকুরের গোস্ত। জান বাঁচাবার জন্যে ঐ শুকুরের গোস্ত খাওয়াও ওর জন্য জায়েয। তো জান বাঁচাবার জন্য খেল ঠিকই, কিন্তু মুখে যখন দিল তখন বেশ মজাও লাগল – ঐ মজা লাগা আবার হারাম। কিন্তু ওর তো এখতিয়ার নাই, ইচ্ছা করে তো আর মজা লাগাচ্ছে না, মজা লেগে যাচ্ছে। তবুও এটাকে নিজের কাছে দোষ মনে করা যে আমার তো মজা লাগা উচিৎ নয়, আমার তো এর প্রতি ঘৃণা থাকা উচিৎ। কিন্তু ঐটা বেএখতিয়ার হিসেবে তবুও মাফ হয়ত হয়ে যাবে যেহেতু আমি ইচ্ছা করে স্বাদ নিচ্ছি না। জান বাঁচাবার জন্য খাচ্ছি কিন্তু মজা লেগে যাচ্ছে, আমি করবো কি। চেষ্টা করা যেন মজা না লাগে। কিন্তু একটা অংশ আছে এখতিয়ারি। খেলাম। এই পরিমাণ খেলে আমার জান বেঁচে যায়। কিন্তু মজা লাগার কারণে এক লোকমা বেশি খেলাম, তো ঐ যে অতিরিক্ত এক লোকমা মজা লাগার কারণে খেয়েছে – ঐটার জন্য সে ধরা পড়বে। জান বাঁচা পর্যন্ত আল্লাহতাআলা জায়েয করেছেন। আর মজা লাগার কারণে ঐটা আবার হারাম। তো ঐ শেষ লোকমার কারণে শুকুরের গোস্ত খাওয়ার দোষে দোষী হবে। এর আগের লোকমা পর্যন্ত মাফ।
আল্লাহতাআলা এই উম্মতের প্রত্যেক ব্যাক্তিকে, মুসলমান তো বটেই, কাফির মুশরিক সবার প্রতি শুভকামী করে পাঠিয়েছেন। সবার খয়ের খা হতে হবে।
যুদ্ধের ময়দানে আসি, ওখানে আবার কঠোরতা অবলম্বন করতে হয়।
قَاتِلُواْ الَّذِينَ يَلُونَكُم مِّنَ الْكُفَّارِ وَلِيَجِدُواْ فِيكُمْ غِلْظَةً
বলা হয়েছে তোমার মধ্যে যেন কঠোরতা থাকে
তো ঐটা ক্বিতালের ময়দানে, ক্বিতাল তরবারী চালাবার জন্যে। ঐ কঠোরতা একটা অবস্থা। ঐটা যদি সৃষ্টি না হয়, তাহলে সে এই কাজ করতে পারবে না। কিন্তু ঐ কঠোরতা খুব সীমিত একটা জায়গায়, একটা ঠেকায় পড়ে করা। এজন্য জিহাদের ভিতরে যেসব আহকাম আছে, ঐসব আহকামের অনেকগুলো খাস। বাইরে এগুলো প্রযোজ্য নয়।
উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু যুদ্ধের ময়দানে। তো উনার চেহারা লাল হয়ে যেত। আর গোঁফ বাইরে ছিল, সামনের অংশ তো ছোট থাকেই, এইটা অংশ লম্বা ছিল। আর চোখও লাল হয়ে যেত। তো যুদ্ধের ময়দান একটা রাগ প্রদর্শনের জায়গা আর ঐটা যুদ্ধের একটা অংশ।
মনে করা যাক, বদরের সময় বা উহুদের সময় মোকাবিলায় এসেছে মক্কার এক গোলাম। তাদের বংশের বা পরিচিত বংশের গোলাম। দেখে চিনতে পারলেন। যেমনি তাকে দেখে চিনতে পারলেন, তেমনি বললেন, এই গোলামের বাচ্চা গোলাম, আয়। এটাও জিহাদের অংশ। এর জন্য সওয়াবও পাবেন। আর এটাকে গাল হিসেবে ধরা হবে না। ঐ তরবারী যেরকম চালাতে হয়। আগের যমানায় শব্দ ছিল না, বর্তমান যমানায় শব্দ আবিষ্কার করেছে ‘স্নায়ুযুদ্ধ’। ঐ যমানায় একজন গোলাম মালিক বা মালিকের সমপর্যায়ের কাউকে দেখলে, ওর এমনি সব হিম্মত উড়ে যেত। আর হিম্মতই থাকে না। তো তার হিম্মত নষ্ট করবার জন্যে বর্তমানে অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যাবহার করা হয় প্রোপাগান্ডা ইত্যাদি, তো ঐ যমানায়ও এটা ছিল। তো সেজন্য এটাও যুদ্ধের একটা অংশ। যদি ওখানে আখলাক দেখাতে যায় যে ‘হযরত তশরীফ আনুন’, তো ঐটা আখলাক দেখাবার জায়গা নয়। প্রত্যেকটার ঠিক মওকা-মাহল আছে। কিন্তু ঐ হুকুমগুলো সীমিত।
পুরুষের জন্য সিল্ক পড়া হারাম, মুক্বাতিলের জন্যে হানাফি মাযহাবে সম্বভত নয়, তবে অন্য কোন এক মাযহাবে হালাল। কালো খেযাব লাগানো শুদ্ধ নয়, কিন্তু মুক্বাতিলের জন্যে ঐটা আবার শুদ্ধ। কারণ তাকে জোয়ান দেখলে প্রতিপক্ষ ভয় পাবে। যুদ্ধের ময়দানে ক্বতল হয়, আর না-হক্ব কতলও হয়, কিন্তু ঐটার কিসাস হবে না।
আবুবকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহুর ছেলেকে তায়েফবাসী যুদ্ধের মধ্যে হত্যা করলেন। তীর লাগল আর পরবর্তীতে ইন্তেকাল করলেন। পরবর্তীতে আবুবকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহুর সামনে এলেন আর নিজেই বললেন যে আমিই ক্বতল করেছি। আবুবকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু কিসাসের ব্যাপারে কোন আলোচনা করলেনই না। এই কথাও বললেন না যে আমি কিসাস নিলাম না, মাফ করলাম। এটা বলারই দরকার নাই। যুদ্ধের ময়দানের ভিতরের ক্বতল, ঐটা কিসাসের হুকুমের মধ্যে আসে না। তো ঐটা সীমিত। ঐ সীমিত অবস্থায় তো তার প্রতি রাগের প্রদর্শনও হবে, কিন্তু আসলে স্থায়ীভাবে তার প্রতি খয়ের খা থাকবে।
বাপ ছেলেকে দুষ্টমি করার জন্যে মারছে। মারের সময় তো রাগই থাকবে। মারের সময় তো আর বলবে না যে ‘বাবা কাছে আয়, তোকে চুমু খাই’। তাহলে তো আর শাসন হবে না। বিপরীত জিনিস। রাগ হবে, রাগের প্রদর্শন হবে, কিন্তু ঐ রাগ খুবই সাময়িক। মূলত ঐ রাগ হয়েওছে মহব্বতের কারণে। ঐ সমান দুষ্টমী যদি পরের ছেলে করতো তাহলে রাগ হত না। যেহেতু ভালবাসে সেহেতু রাগ হচ্ছে। তারপর পিটানোর পরে ডেকে আবার বাপ আদরও করে। ঐটা শেষ। ঐটা খাস অবস্থায় ছিল।
তো আল্লাহতাআলা আমাদের দ্বীনের মেহনত দিয়েছেন। দ্বীন আমাদেরকে প্রত্যেক আমলের শুদ্ধতা যেমন শিখিয়েছে, তেমনি তার সীমানাও শিখিয়েছে।
আয়শা রাদিয়াল্লাহু আনহা জঙ্গে জামালে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর জামাতের কাছে কয়েদী হলেন। রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যমানায় যুদ্ধ হয়েছে, আবুবকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহুর যমানায় যুদ্ধ হয়েছে, কিন্তু মুসলমানদের ভিতরে হয়নি। যুদ্ধ হয়েছে, কয়েদীরা গোলাম, দাস-দাসী, তাদের সম্পদ গণীমত। আর এখানেও যুদ্ধ হয়েছে, এখানেও সম্পদ পেয়েছেন, এখানেও কয়েদী হয়েছেন, তো এরাও গোলাম। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর সাথীরা বলল যে ‘যারা কয়েদী হয়েছে তারা গোলাম, বন্টন করে দাও আমরা নিব, তাদের মহিলারা আমাদের দাসী হবে’। কিন্তু এখানে ক্ষেত্র তো ভিন্ন, এরা মুসলমান। আর আগের যুদ্ধগুলোতে ওরা ছিল কাফির। কিন্তু এই ব্যাপারে পরিষ্কার কোন আয়াত, হাদীস কিছুই নাই। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর ব্যাপারে রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা আছে
أكض كمال
বিচারের ব্যাপারে আল্লাহতাআলা উনাকে বড় সুক্ষ্ম বুদ্ধি দিয়েছেন। উনি বেশি তফসীর-দালায়েলে গেলেন না। শুধু বললেন ‘আয়শাকে কে তার দাসী বানিয়ে নিবে’। ঐ এক প্রশ্ন সব মাসআলা হাল করে দিল। তো আল্লাহতাআলা এমন অবস্থা দিয়েছেন আর সেই অবস্থার সাথে সাথে এমন এক কাযীকে দিয়েছেন যে ভবিষ্যতের জন্য, কিয়ামত পর্যন্ত মাসআলা হাল করে দিয়েছেন।
আয়শা রাদিয়াল্লাহু আনহা আছেন বলে যুদ্ধ করবো না, তা নয়। যত বড় সম্মানের অধিকারী হোক না কেন, আমি যদি মনে করি এটা অশুদ্ধ তো অশুদ্ধই। আমি যার শাগরেদ, উনি ফতোয়া দিয়েছেন। কিন্তু উনার ফতোয়া আমার দৃষ্টিতে শুদ্ধ নয়। তো উনার এখতেরামের কারণে আমি আমার মত পরিবর্তন করলাম, এটা তোষামদের মাসআলার মধ্যে পড়ে।
আবু হানিফা রহঃ এর নিজস্ব ফতোয়া হচ্ছে এক দিনের কমে এতেকাফ হয় না, আর ইমাম মুহাম্মদ রহঃ এর ফতোয়া হচ্ছে অল্প সময়ও এতেকাফ হয়। তো এমন ‘বেয়াদব’ শাগরেদ যে ওস্তাদের সম্মানই চিনল না। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে যে তাঁরাই দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন যে ওস্তাদের শাগরেদ কেমন করে হতে হয়। শুদ্ধ যেটা আমার মতও ঐটাই। আমি যদি একটাকে শুদ্ধ মনে করি তাহলে আমি ঐটার উপরেই আমল করবো।
আপবীতিতে আছে। কার কথা ভুলে গেলাম। সম্ভবত ইয়াহইয়া রহঃ বা ঐ পর্যায়ের আলিম, আল্লাহওয়ালা। ঈদের দিন। বাপের ঘর আর ছেলের ঘর পাশাপাশি। চাঁদ সরাসরি দেখা যায়নি। এজন্য ঈদ হবে কিনা – বাপ ও ছেলের মধ্যে ইখতিলাফ হয়ে গেছে। কেউ জিজ্ঞেস করতে এসেছে যে আজকে ঈদ কিনা। বাপ বললেন যে আমার রায় অনুযায়ী আজকে ঈদ, ওর রায় অনুয়ায়ী আজকে নয়। পাশাপাশি ঘর। বাপ ঈদ করছেন, ছেলে ঈদ করছেন না। এখন তোমার এখতিয়ার যেটা তুমি করতে চাও। আর এটার জন্য বাপও মনে করছেন না যে ‘কেমন বেয়াদব, আমার ফতোয়ার উপর সে ফতোয়া দেয়’। আর ছেলেও মনে করছেন না যে বাপ যখন বলে ফেলেছেন, ফতোয়া ফতোয়ার জায়গায় থাকুক, আমি এখন ছেলেগিরি করি। উনার দৃষ্টিতে এই খবরে ঈদ হয় না, অতএব মানি না। আব্বার দৃষ্টিতে হয় কিন্তু আমি মানি না।
তো আল্লাহতাআলা দ্বীনের মেহনত দিয়েছেন। এই মেহনতের কারণে গীবত করা হয় বিদাতিদের। বিদাতিদের আড়ালে তার আলোচনা করা হয়, কিন্তু ওখানেও সীমা আছে। এক তো হল যে ওর দোষের আলোচনা যদিও আমি করছি, কিন্তু এটার জন্য মনে যেন একটা ব্যাথা থাকে। এটা কোন মজার জিনিস নয়। সেই বিদাতি পীর টাকা মারে, কিসব কেলেংকারী করে বা অনেক খারাপ জিনিস। বাধ্য হয়ে মানুষকে সাবধান করে দেওয়ার জন্য তার অনেকগুলো ব্যাক্তিগত দোষের আলোচনাও প্রয়োজন হয়। ধরা যাক আমার ভাই। সে তার জোয়ান মেয়েকে নিয়ে পীরের কাছে চলে যায়। বললাম,
তোমার এই পীর সাহেবের অমুক ঘটনা জান?
কি ঘটনা?
কি ঘটনা একটু ভাল করে জেনে নিও।
চাবি একটা দিয়ে দিল। তারপর সে খোঁজ খবর করে দেখল যে ঘটনাটা কি হয়েছিল। এই কথা না বললে তো সাবধান করা যাচ্ছে না। এর আগেও সাধাসিধাভাবে বলেছি কোন এক মাসআলার মধ্যে ফেলে দিয়ে। কিন্তু ঐ মাসআলা ভাইয়ের মাথায় ঢুকেনি। তো শেষ পর্যন্ত ওকে বলতে হল যে অমুকের সাথে তোমার পীর এই এই করেছে। তো যার সাথে সে এগুলো করেছে সে তোমার মেয়ের চেয়ে কম সুন্দর। তো তোমার মেয়েও ওখান থেকে বাঁচবে না। বলতে হল। কিন্তু বলছে বা ওর দোষের যে আলোচনা করছে, এই দোষের আলোচনা করার সময় ওর মনে যেন ব্যাথা থাকে। এটা কোন আনন্দের বিষয় না। ঠেকায় পড়ে করতে হচ্ছে। আর যেখানে ঠেকা নেই, ওখানে যদি করি তাহলে ঐ অতিরিক্ত শুকুরের গোস্ত খাওয়ার মত হবে। জান বাঁচা পর্যন্ত তো হালাল ছিল, কিন্তু অতিরিক্ত যেটা মজা করে খেলাম, ঐটা হারাম।
তো মানুষকে সাবধান করে দেওয়ার জন্যে যে পরিমাণ দোষের চর্চা করা দরকার, ঐ পরিমাণ চর্চা করলাম মানুষকে সাবধান করে দেওয়ার জন্যে – ঐটা পর্যন্ত হালাল। কিন্তু তারপরে গল্প হিসেবে করলাম, ঐটা হারাম। আর ঐ জায়গায় এসে গীবতের গুনাহের মধ্যে পড়ে যাবে।
তো আল্লাহতাআলা আমাদের দ্বীন দিয়েছেন, কিন্তু দ্বীনের সীমানা বুঝার চেষ্টা করি। সীমানা যেন লঙ্ঘন না হয়।
وَلَا تُطِعْ مَنْ أَغْفَلْنَا قَلْبَهُ عَن ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ وَكَانَ أَمْرُهُ فُرُطًا
তাদের অনুসরণ করবে না যারা গাফেলতের মধ্যে পড়ে গেছে আর মনের অনুসরণ করে আর তার সব কাজ সীমা লঙ্ঘন করে
যার যে জায়গায় হক্ব, সেই হক্বগুলো রক্ষা করা। তো বাপের যেরকম হক্ব আছে, চাচারও হক্ব আছে চাচা হিসেবে। চাচাত ভাইয়েরও হক্ব আছে চাচাত ভাই হিসেবে। আর এই সিলসিলা চলতে থাকে। পীর হিসেবে পীরের হক্ব আছে, পীরজাদারও হক্ব আছে। হতে পারে ঐ পীরজাদা একজন ফাসেক। ফাসেক হওয়ার কারণে আমি তার কাছে মুরীদ হয়ে যাব না, তার কথামত চলবো না, কিন্তু আমার পীরের ছেলে হিসেবে তার যে হক্ব আছে, ঐটা বাতিলও হবে না। ঐটা ঐটার জায়গায় রয়ে যাবে। বাপ মদ খায়, তো বাপ বলে মদ খাওয়া তো সওয়াবের হয়ে যাবে – না, তাও নয়। আর মদ খায় বলে উনি আমার বাপই নয়, তাও নয়। বাপ বাপের জায়গায় রয়েছে, আর মদ খাওয়া মদ খাওয়ার জায়গায় রয়েছে।
সব যামানায় আল্লাহওয়ালারা আল্লাহওয়ালাদের নেসবতেরও সম্পর্ক রাখেন। মুজাদ্দিদ আলফে সানী রহঃ এর কথা আজকেও হচ্ছিল যে উনার ওয়ারিসদের ওসিয়্যত করে গেছেন যে আহলে বাইতের ইয়াদ করবে। মালফুজাতের মধ্যে এই ব্যাপারে বেশ কিছু কথা আছে। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেসবতের কারণে। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেসবতে পরবর্তী যারা আছে, এরা সবাই যে মুত্তাকী, তা মোটেও নয়। অনেক ফাসিক, ফাযির আছে। তো ফাসিক ঠিকই ফাসিক, আর ফাযির ঠিকই ফাযির, কিন্তু যদি ঐ নেসবত থাকে তাহলে ঐ নেসবত এটার জন্য বাতিল হয় না। সেটারও সম্মান আছে। ঐ চাচার সম্মান যেরকম, শশুরের সম্মান যেরকম। আমার শশুর চোর, চুরি করে ঠিকই। চুরি করে বলে ওর জিনিস খাবও না, কিন্তু শশুর হিসেবে মানব না তাও নয়। এই দুই জিনিস রক্ষা করা অনেক সময় খুব সহজ নয়। এই সীমানাগুলো বুঝে চলার জন্য অনেক সুক্ষ্ম বুদ্ধির প্রয়োজন হয়, হিকমতের প্রয়োজন হয়। কিন্তু যে ফিকিরবন্দ হয়, আল্লাহতাআলা তাকে ঐটা দান করেন। চেষ্টা করলে সে ঐ মাঝখানের পথ পেয়ে যাবে।
দ্বীনের এই মেহনত তবলীগের কাজ পেয়েছি মাওলানা ইলিয়াস রহঃ এর মাধ্যমে। ইলিয়াস রহঃ এর যে নেসবত, এই নেসবতেরও আমাদের উপর হক্ব আছে। আর এই হক্বগুলো যে শুধু একটা ওলীআল্লাহদের কাছে একটা প্রচলন, তাই নয়। এটা একটা মুস্তাকীল আর এর সমর্থনে দলীল আছে।
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ، وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ
দুরুদ শরীফ এভাবেই পড়তে হয়। ঐ آلِ مُحَمَّدٍ এর মধ্যে অনেকেই এসে যায়। সে যমানার, পরবর্তীকালের সব এসে যায়। যাদের কাছে আমরা দ্বীন পেয়েছি তাদের হক্বও আছে। গাঙ্গুহী রহঃ এর সম্ভবত নাতনী এসেছিলেন মাওলানা ইলিয়াস রহঃ এর কাছে। পর্দার আড়ালে কথা বলছেন। কথার মধ্যে বললেন ‘আমি আপনার পরিবারের, গুষ্ঠির গোলাম। অথচ নাতনী। ছেলেও না, মেয়েও না, নাতনী। আর এগুলো যে বলতেন, যেহেতু উনি এসেছেন; তো কৃত্রিমভাবে কিছু একটা বললাম, তা নয়। দ্বীল থেকে, আচরণ থেকে বুঝা যায় যে মন থেকেই বলছেন। সম্মান খাতির করলেন।
তো আবার ঐ কথা যে ধরা যাক পীরের নাতিকে পেলাম। পীরের নাতি কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে অনেক ভুল কাজ করে। পীরের নাতি হিসেবে তার ভুল কাজের সমর্থন করবো, তাও নয়। আর ভুল করার কারণে তার মান মর্যাদা রক্ষা করবো না, তাও নয়। সবটা তার নিজ জায়গায়। আর এই নিজ জায়গায় প্রত্যেক জিনিসেরই মাপ শুদ্ধ রাখা। এটাই পুরা দুনিয়ার সৌন্দর্যের শর্ত, সব আমলের সৌন্দর্যের শর্ত।
উঁচু নাক আমাদের দেশে খুব সৌন্দর্যের জিনিস মনে করে। বোঁচা নাকের তুলনায়। এখন উঁচু নাক এমন হল যে এক হাত লম্বা। তো সুন্দরী হবে নাকি। একটা নির্দিষ্ট মাপের মধ্যে হতে হবে। হালুয়াতে ভাল ঘি দরকার, কিন্তু ঘি যা দরকার তার চেয়ে যদি অতিরিক্ত হয়ে যায় তো ঐ হালুয়া খাওয়াই যাবে না। মেহমান বেশি হয়েছে, পোলাও কম, ঘি ঢেলে দেয়। তখন আর খাওয়া যায় না। দুই লোকমা খেয়েই বিরক্ত লাগে।
তো ভাল জিনিস যত ভালই হোক, তার শুদ্ধ মাপ আছে। মাপ লঙ্ঘন করলে ঐটা আর টিকবে না।
وَخَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ فَقَدَّرَهُ تَقْدِيرًا
প্রত্যেক জিনিসকে আল্লাহতাআলা তার ঠিক মাপমত মেপে দিয়েছেন
মানুষের শরীরে ভিতরে বিভিন্ন ধরনের জিনিসের এত সুক্ষ্ম মাপ আছে যে একটু এদিক সেদিক হয়ে গেলে শরীর খারাপ। কখনো কখনো সেও ডাক্তারের কাছে গেল। ডাক্তার নানান ধরনের টেস্ট করায়। টেস্টে যে আধুনিক যন্ত্রপাতি আছে, ওগুলো ইলেকট্রনিক সুক্ষ্মতার সাথে করে। কিন্তু সেই যন্ত্রপাতিগুলো অনেকগুলো ইমব্যালান্স ধরতে পারে না। অল্পটুকো ইমব্যালান্স কিছু একটা হয়েছে যে ঐ ইলেকট্রনিক যন্ত্রে ধরাও পড়ে না। ওর শরীর কিন্তু বুঝে ফেলে। কেমন কেমন লাগছে। আর এই সুক্ষ্ম মাপের উপর চলা। একটু বেশি হয়ে যায় তো বেঠিক, একটু কম হয়ে যায় তো তাও বেঠিক।
তো দ্বীনও আমাদের কাছ থেকে এই সুক্ষ্ম মাপ চায়। বাকী হল যে এত কঠিন মাপ ইলেকট্রনিক যন্ত্রই বুঝতে পারে না, আমি কেমন করে বুঝবো। আমার বুঝার দরকার নেই। আমি আমার মাপ ঠিক করি নাকি। শুদ্ধভাবে আমি যদি চলবার চেষ্টা করি আর যা করণীয়, তা করতে থাকি, তাহলে আমার অজান্তেই আল্লাহতাআলা সব মাপগুলোকে ঠিক রাখবেন। দ্বীনের ক্ষেত্রেও আমি যদি আল্লাহকে ভয় করে চলি, দ্বীনের কাজ করছি আর দ্বীনের কাজ করতে গিয়ে অনেক লোকের ভুলের আলোচনাও করতে হচ্ছে, খারাপের চর্চাও করতে হচ্ছে, কিন্তু এর সবগুলোই তাক্বওয়ার মেজাজের উপর করার চেষ্টা করছি, এটা আল্লাহর ওয়াস্তে করছি, এটা কোন ফুর্তির জন্য নয়। কিন্তু মানুষের খারাপের আলোচনা করতে বেশ মজা লাগে, মানুষ যেরকম গল্প করে, তো ঐ মজা লাগার জন্য নয়। দ্বীনি কাজ হিসেবে করছি। আমার মধ্যে যদি ঐ অনুভুতি থাকে, আল্লাহতাআলা ইনশাআল্লাহ আমাদের হেফাজত করবেন। আল্লাহ তৌফিক নসীব করুন। দ্বীনের সব কাজের ব্যাপারে আল্লাহর কাছে চাওয়া যেন কাজ আমাদের সুন্দর হয়।
اللَّهُمَّ أَعِنِّيْ عَلَى ذِكْرِكَ وَشُكْرِكَ وَحُسْنِ عِبَادَتِكَ
ইবাদতের সব কাজ যেন তাআব্বুদান হয়। প্রথমত ঐটা যেন ইবাদত হিসেবে হয়। এমনি ঐটা করলাম – তা নয়। আল্লাহর ধ্যানের সাথে, সুন্নাতের খেয়াল রেখে তবেই ঐতা তাআব্দুয়ান হবে। আল্লাহর ওয়াস্তে করছি, আল্লাহর হুকুম হিসেবে করছি।
إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا
আল্লাহর আদেশ হিসেবে, আল্লাহর সন্তুষ্টির আশা করে। তো এই দুই জিনিস যদি খেয়ালের মধ্যে থাকে তাহলে তার শর্তগুলো চেষ্টা করবো বজায় রাখার। যদি আমার মনের ফুর্তির জন্য করি, তাহলে মন যেভাবে চাইবে সেইভাবে করবো। আর যদি আল্লাহর ওয়াস্তে করি, তাহলে আল্লাহ যেভাবে দাবি করেন, সেইভাবে করার চেষ্টা করবো। আর যে বুঝার চেষ্টা করে, আল্লাহতাআলা তাকে বুঝিয়ে দেন। আল্লাহতাআলা আমাদের বুঝার তৌফিকে নসীব করুন।
سُبْحَانَ اللّهِ وَ بِحَمْدِهَ
سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْك
سُبْحَانَ  رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصِفُون وَسَلَامٌ عَلَى الْمُرْسَلِينَ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينََ



No comments:

Post a Comment