Thursday, June 16, 2016

আকাশের দরোজাটা খোলা!

আকাশের দরোজাটা খোলা!
----------------------------------------
শায়খ আলী তানতাভী’র ভাষায়—
‘প্রিয় পাঠক! এখন আমি তোমাদেরকে একটা গল্প শোনাবো। গল্পটা এক আমেরিকান পরিবারের। সদস্য সংখ্যা— আটজন। বাবা মা ও ছয় সন্তান। বাবা কৃষক। বড়ো কর্মঠ মানুষ তিনি। শরীর স্বাস্থ্যও বেশ সুঠাম সুগঠিত। তার মনোবলও খুব আকাশছোঁয়া। যা করতে চান, তা করেই ফেলেন। আর মা ছিলেন বুদ্ধিমতি গুণবতি এক মহিলা। সাধারণ এক কৃষকের বউ হলেও গুণ-বুদ্ধি ও কৌশলে এবং বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতায় তিনি ছিলেন অনেকের চেয়ে সেরা। তাই ছেলে-মেয়েরা গড়ে উঠছিলো তার পরিকল্পিত তত্ত্বাবধানে। মায়ের কাছ থেকে তারা শিখছিলো— কীভাবে বড় হতে হয়। কীভাবে মানুষ হতে হয়। বিপদ এলে ধৈর্য ধরতে হয়। সব প্রতিকুল পরিস্থিতিকে জয় করে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। এমন বাবা মা’র লালন-প্রতিপালন ও তত্ত্বাবধানের ছায়ায় তাই ছেলেরা বেড়ে উঠলো পূর্ণ হয়ে। বড় হওয়ার আগেই তারা বড় হয়ে গেলো।

সবার ছোট্ট ভাইটি একদিন বাইরে খেলছিলো। বয়স আর কতো হবে, মাত্র তের। এ বয়সের খেলায় একটু দুরন্তপনা থাকেই। এ বালকও মেতে উঠেছিলো তেমন দুরন্তপনায়। একটা শিলাখণ্ড থেকে লাফ দিতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এসে পড়লো নিচে। পায়ে ও হাটুতে চোট লাগলো। প্রচণ্ড ব্যথা পেলো। ব্যথা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো। ওর বয়সী কোনো ছেলেই অমন ব্যথা সহ্য করতে পারতো না। কিন্তু ও সহ্য করলো। কাউকেই  কিছু বুঝতে দিলো না। রাত গড়িয়ে সকাল এলো। ওর পাঠশালায় যাওয়ার সময় হলো। এ-ব্যথা নিয়ে পাঠশালায় না যাওয়াটাই স্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু ও গেলো এবং পায়ে হেঁটেই গেলো। এ দিকে ব্যথা বাড়ছিলো, তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিলো। ওর ধৈর্যও বাড়ছিলো। এভাবে দু’দিন কেটে গেলো। পা ফুলে গেলো। ব্যথার তীব্রতায় জায়গাটা নীল হয়ে গেলো। এক কদমও আর চলা সম্ভব হচ্ছিলো না। তখন মা-বাবা জানতে পারলেন এবং রাজ্যের শঙ্কা এসে ছায়া বিস্তার করলো তাদের চোখে-মুখে-অনুভবে। তারা ভীষণ অস্থির হয়ে পড়লেন। তাদের কলিজার পানি শুকিয়ে গেলো। তারা উদ্বেগভরে জানতে চাইলেন— ‘এ অবস্থা কী করে হলো?’ এবার ও সবকিছু জানালো। ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে। তখন তারা দ্রুত তাকে বিছানায় শুইয়ে দিলো এবং ডাক্তার ডাকতে বেরিয়ে গেলো। ডাক্তার এসে সব দেখলো। কিন্তু কোনো সুসংবাদ শোনাতে পারলো না। উল্টো দিলো এক মহা দুঃসংবাদ। বললো :
— চিকিৎসার সময় ফুরিয়ে গেছে! পা কেটে ফেলতে হবে! এবং করতে হবে তা এই মুহূর্তেই, নইলে তাকে বাঁচানো যাবে না। কেননা ওর রক্ত দূষিত হয়ে গেছে!
এ-সব মা-বাবাকে বলা হলো এক পাশে এনে কানে কানে, ছেলের অগোচরে। ডাক্তারের একেকটা কথা গিয়ে বিঁধছিলো বাবা-মা’র অনুভবে কাঁটার মতো! ছেলের পা কেটে ফেলতে হবে? এ কী করে সম্ভব! ও সারা জীবন পা-হারা থাকবে? কেমনে চলবে? তবুও বাস্তবতা মেনে নিতে হলো! ওর জীবনের মায়ায় পা কাটতে তারা রাজি হলেন। কাঁদতে কাঁদতে ছেলেকে গিয়ে বললেন :
— তোমার পা কেটে ফেলতে হবে দ্রুত, নইলে তোমাকে বাঁচানো যাবে না!
কিন্তু ছেলে আরো বেশি অপ্রস্তুত হয়ে গেলো এ কথা শোনে! ও পরিস্কার বলো দিলো— ‘না’! গলা ফাটিয়ে কেঁদে উঠলো! বললো :
— তোমরা আমার পা’টা কেটে ফেলো না! বাবা! তুমি আমাকে বাঁচাও! আমার পা কেটে ফেললে আমি হাটবো কেমন করে! বাবা! আমাকে রক্ষা করো! ডাক্তারকে এক্ষুনি চলে যেতে বলো!
ছেলেটা এক পায়ে ভর দিয়ে বিছানা ছেড়ে পালাতে চাইলো। কিন্তু বাবা ওকে ধরে ফেললেন। বিছানায় জোর করে শুইয়ে দিলেন। তখন ও আরো বেশি ভয় পেয়ে গেলো! ওর আর্তচীৎকার আরো বেড়ে গেলো—
— মা! আমাকে বাঁচাও! মা! আমার পা কাটতে দেবে না!
অশ্র“সিক্ত মা পাশে দাঁড়িয়েছিলেন নিথর হয়ে। কী করবেন তিনি? ছেলের ডাকে সাড়া দেবেন না ডাক্তারের উপদেশ মানবেন? তার হৃদয়টা হাহাকার করে উঠলো। কোন্ দিকে যাবেন তিনি? কিছুই বুঝতে পারছিলেন না! দাঁড়িয়ে রইলেন অশ্র“প্লাবিত দৃষ্টি নিয়ে আর ভেঙে যাওয়া হৃদয়ের সীমাহীন ব্যাকুলতা নিয়ে! হায়! তিনি যদি পারতেন ছেলের জন্যে নিজের জীবনটা বিলিয়ে দিতে!
ছেলেটার কান্না ও চীৎকার থামছেই না। মায়ের দিকে ও অশ্র“-করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আকুলি-বিকুলি করছিলো। পানিতে ডুবে যেতে যেতে মানুষ যেভাবে উদ্ধারকারীর উদ্দেশ্যে হাত পা ছুঁড়তে থাকে, ঠিক সেভাবে!
কিন্তু মায়ের আজ কী হয়ে গেলো? মা যে তার ডাকে সাড়া দিচ্ছেন না! মাও কি আজ পর হয়ে গেলেন, বাবার মতন? পৃথিবীর সবাই কি পর হয়ে গেলো? .......

বাবা’র পর ও মা’র ব্যাপারেও হতাশ হয়ে গেলো। এবার আরেকটা নাম ধরে ও চিৎকার করতে লাগলো। ওর বড় ভাইয়ের নাম! বেশি না, ওর চেয়ে সামান্য বড়। পিঠাপিঠি ভাই। এক সাথেই খেলে ওরা। যেনো সহপাঠি, বন্ধু! ও কি এখন সাড়া দেবে? আসবে কি ওকে বাঁচাতে? ওর পা’টাকে রক্ষা করতে? ইদগার! ইদগার! কোথায় তুমি ভাইয়া? এসো না! তুমিও কি আসবে না? তুমিও সবার মতো পর হয়ে যাবে?
ইদগার শুনলো ভাইয়ের আর্ত আবেদন! সাথে সাথে ঝড় উঠলো ওর ভ্রাতৃহৃদয়ে! ছুটেও এলো ঝড়ের গতিতে! এসে দাঁড়ালো ভাইয়ের কাছে, ওর দরোজার মুখে। তারপর? তারপর একটা কাপড় দিয়ে কোমরটা বাঁধলো! কী বলে যেনো বুকে দম করলো!
তারপর? তারপর ঘোষণা করলো—
— সাবধান! তোমরা এদিকে কেউ আসবে না! ওর পা কাটতে আমি দেবো না! ও এমনিতেই সেরে ওঠবে!!
বাবা কাছে এগিয়ে গেলেন! ইদগারকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, পারলেন না!
মা গেলেন, তিনিও পারলেন না! ইদগার যেনো কোনো ছোট্ট কিশোর নয়—  এক বীরপুরুষ! এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে জীবনপণ লড়াইয়ে! একদিকে ওর ‘মাজলুম’ ভাই, অন্যদিকে একদল ‘হৃদয়হীন’ মানুষ! না! ইদগার আজ আপোষ করবে না! যে কোনো মূল্যে ভাইটিকে ‘দুষ্ট-স্পর্শ’ থেকে বাঁচাবে, বাঁচাবেই!
বাবা ইদগারকে কথার জোরে বোঝাতে না পেরে গায়ের জোরে সরিয়ে দিতে চাইলেন। পারলেন না! ইদগার ভাইয়ের জন্যে বাবাকে একদম খাতির করলো না। তাকে এবং ডাক্তারটাকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো!
অবাক লাগছে? না, অবাক হওয়ার কিছু নেই! ইদগার এখন সিংহ! যে কোনো মূল্যে এখন ও রক্ষা করতে চায় ভাইকে, তার পা’কে!
এখন সব মানুষ ওর কাছে পর— ভাইটি ছাড়া!
এখন সব মানুষ ওর দুশমন— ভাইটি ছাড়া!
এমন সঙ্গিন মুহূর্তে বিড়ালও হয়ে যায় বাঘ!
মুরগীর কথাই একটু ভাবো! মুরগীর কোনো বাচ্চার উপর কেউ হামলে পড়লে তখন মুরগীটি কেমন পাখনা ফুলিয়ে হামলাকারীকে তেড়ে যায়—  দেখেছো কখনো! কিংবা বিড়ালের কথাই ধরো! বিড়াল যখন জীবনের আশা ছেড়ে দেয়, তখন কেমন করে দাঁত খিচিয়ে আক্রমণকারির উপর হামলে পড়তে উদ্ধত হয়— দেখেছো?! নিশ্চয়ই দেখেছো! মুরগীটি তখন হয়ে যায় একটা শিকারি বাজ আর বিড়ালটা হয়ে যায় একটা হিংস্র নেকড়ে! ইদগারের অবস্থাটাও তাই! এখন সে বীর! এখন দেয়াল টলে যেতে পারে কিন্তু ইদগার টলবে না। বাবা-মা এবং ডাক্তার অবস্থা বেগতিক দেখে চলে গেলেন। ভাবলেন— ধীরে ধীরে ইদগার শান্ত হয়ে আসবে। ক্লান্ত হয়ে, বিরক্ত হয়ে তাদের কথা মানতে বাধ্য হবে। ঘুম ও ক্ষুধার কাছে আত্মসমর্পণ করবে। কিন্তু বেলা গড়ানোর পরই বোঝা গেলো, তারা এক নতুন ইদগারের মুখোমুখি হয়েছে। এই ইদগারের সাথে কোনো কালেই তাদের পরিচয় ছিলো না। ও প্রায় না ঘুমিয়ে এবং না খেয়েই  ভাইয়ের পাহারায় অবিচল রইলো। কেউ ওর ধারে কাছেও ভিড়তে পারলো না। ডাক্তার একটু পর পর এসে অবস্থা নিরীক্ষণ করছিলো নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে। ডাক্তার কাছে আসা মাত্রই ইদগারের লাল চোখ আরো লাল হয়ে ওঠে। এই লালের সামনে ডাক্তার টিকতে পারে না। অসহায় ভঙ্গিতে ফিরে যায়। হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফেলে। এদিকে ছেলেটার পা আরো ফুলে গেলো। সাথে সাথে নীলে নীল! ডাক্তার আর পারলো না। পুরোপুরি হাত গুটিয়ে নিলো। অশ্র“ভারে আক্রান্ত বাবা মা’র চোখে চোখ রেখে যাবার আগে শুধু বলে গেলো :
— পারা গেলো না! ছেলেটাকে আর বাঁচানো গেলো না! আমি চলে গেলাম! এখানে থেকে সময় নষ্ট করে লাভ নেই! এখন অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ওর পা কেটেও ওকে এখন আর বাঁচানো যাবে না। ওর সামনে অপেক্ষা করছে মৃত্যু। বেদনাময় নীল মৃত্যু!

ডাক্তার চলে যাওয়ার পর বাড়ির পরিবেশটা আরো ভারি হয়ে উঠলো। ছলোছলো নীরব দৃষ্টির ভাঁজে ভাঁজে ঝরে পড়তে লাগলো নীল বেদনা ও হতাশা! সেখানে নেই এখন কোনো আলো। একটু আগে ডাক্তার আশার ক্ষীণতম আলোটিও নিভিয়ে রেখে গেছে!

কঠিন বিপদের মুহূর্তে মানুষ কী করে?
আসলে মানুষ যখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়ায়, মানুষ যখন জীবনের আশা একেবারেই ছেড়ে দেয়, তখন সে আল্লাহর  কাছে ফিরে আসে। মু’মিন হোক কিংবা কাফের। মু’মিন তো তখন ফিরে আসেই, কাফেরও ফিরে আসে। কারণ সব মানুষের হৃদয়েই ঈমান লুকিয়ে আছে। এমনকি কট্টর কাফেরের হৃদয়েও। এ জন্যেই আরবী ভাষায় ‘কাফির’ মানে ‘সাতির’। আর সাতির মানে যে নিজের ভিতরে ঈমানকে লুকিয়ে রাখে। যদিও সে ভাবে— তার ভিতরে ঈমান বলতে কিছু নেই। এ জন্যেই বিপদের কঠিন মুহূর্তে লুকিয়ে থাকা সেই ঈমানটাই জেগে ওঠে। কুফরির আবরণ ছাপিয়ে উদিত হয় ঈমানের সেই আলোটা। তাকে দেখায় সঠিক পথ। নিয়ে যায় আল্লাহর আশ্রয়ে। তাকে বাধ্য করে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করতে।
কুরাইশরা মূর্তিপূজা করতো। হোবল-লাত-উয্যা’র উপাসনা করতো। কিন্তু কখন? যখন থাকতো না বিপদ ও সঙ্কট। মূর্তি দুর্বল, কিছুই করার ক্ষমতা ওরা রাখে না— এ বিশ্বাসই ওদের ভিতরে কাজ করতো। তারপরও পূর্ব পুরুষের দোহাই টেনে টেনে ওরা মূর্তিপূজা করতো। কিন্তু যখন আসতো বিপদ ও সঙ্কট! যখন বইতো ঝড় ও তার তাণ্ডব, তখন কী করতো ওরা?
বাণিজ্যিক ভ্রমণে নৌকায়  আরোহন করতে হতো ওদেরকে প্রায়ই। তখন সমুদ্র-ঝড়ে পড়লে কী করতো ওরা? যে ঝড়ে নৌকা নিয়ে ঢেউ খেলা করে ঠিক সেভাবেই, যেভাবে ঘূর্ণিবায়ূ খেলা করে পাখির পালক নিয়ে? সেই সঙ্কটকালে তারা কার কাছে আত্মসমর্পণ করতো? লাত-ওয্যা ও হোবলের কাছে নাকি আল্লাহ্র কাছে? না! তখন লাত-ওয্যা ও হোবলের কোনো মূল্য ছিলো না তাদের কাছে, তারা বরং তখন আশ্রয় নিতো আল্লাহর কাছে। তখন সেই লুক্বায়িত ঈমান জ্বলে উঠতো তাদের হৃদয়ে। পরিত্যক্ত হতো লাত উয্যা ও হোবল মানাত। যতো বড় কাফেরই হোক, নৌকাডুবি হলে এবং অথৈ পানিতে কিছু একটা ধরে বেঁচে থাকার চেষ্টাকালে হৃদয় থেকেই ভেসে আসে এই আর্ত আকুতি— হে আল্লাহ! হে আসমান জমিনের মালিক! আমাকে বাঁচাও!
ফেরাউনের সলীল-সমাধি’র কালো ইতিহাস আমাদেরকে কী বলে? অহঙ্কারী ফেরাউন ডুবে যাওয়ার মুহূর্তে কী বলেছিলো? বলেছিলো কি— ‘আমিই সবচে’ বড় প্রভু’? না বলে নি! বলতে পারে নি! কেননা ফেরাউনের হৃদয়ের গভীরেও ঈমানের বীজ লুকিয়ে ছিলো! মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে তাই তার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিলো—
﴿ آمَنتُ أَنَّهُ لا إِلِـهَ إِلاَّ الَّذِي آمَنَتْ بِهِ بَنُو إِسْرَائِيلَ وَأَنَاْ مِنَ الْمُسْلِمِينَ ﴾
‘আমি ঈমান আনলাম যে নেই কোনো ইলাহ সেই সত্তা ছাড়া, যার প্রতি ঈমান এনেছে বনী ইসরাঈল। আর আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত।’

মনে করো, তুমি মরুভূমিতে সফর করছো। প্রচণ্ড পিপাসায় ছটফট করছো। পান করার মতো এক কাতরা পানিও নেই। মৃত্যু ধেয়ে আসছে চারদিক থেকে তোমার দিকে। তখন তুমি কী করবে? ডেকে ওঠবে না কি আর্তনাদ করে— ‘হে আল্লাহ! হে আল্লাহ!!’ বলে?!

যখন নেমে আসে দুর্ভিক্ষ কিংবা অনাবৃষ্টি। চারদিকে কেবল হাহাকার। ‘নেই নেই’ হাহাকার। নেই পানি, নেই খাবার! তখন কার কাছে মানুষ ফিরে যায়? আল্লাহর কাছেই ফিরে যায়!
তুমুল যুদ্ধের সময় মৃত্যু যখন সামনে এসে হাজির হয়, তখন কার কাছে মানুষ আশ্রয় চায়?
সব চিকিৎসা এবং সকল ডাক্তার যখন ব্যর্থ হয়ে যায়, তখন কার কাছে মানুষ ফিরে যায়?
আল্লাহ্র কাছে! অবশ্যই আল্লাহ্র কাছে!!
তখন আল্লাহদ্রোহী আল্লাহর সাথে দ্রোহ করতে ভুলে যায়!
তখন বস্তুবাদী বস্তুবাদে বিশ্বাস করে না।
নাস্তিকও তখন আস্তিক হয়ে যায়! সবাই সমকণ্ঠে বলে ওঠে—
আল্লাহ! আমার আল্লাহ! আমাকে বাঁচাও! আমাকে উদ্ধার করো! আমাকে এবারের মতো মাফ করে দাও!!

ডাক্তার চলে গেলো!
তারপর কী হলো?
তারপর হতাশার অন্ধকারে সব হারিয়ে গেলো!
অসুস্থ ভাইটি হতাশ! ইদগারও হতাশ! বাবা-মা আরো বেশি হতাশ! ডাক্তার আরো বড় হতাশ!
এই হতাশার অন্ধকারে কোনো আলো দেখা গেলো না! আলোর ছিটে-ফোঁটাও না!
সবাই উপায়হীন! সবাই সম্বলহীন!
সবাই অসহায়! দিকভ্রান্ত!
তখন, হ্যাঁ তখনই সবার হাত উঠে গেলো আকাশের দিকে! এক আল্লাহ্র দিকে! তাঁর কাছেই চাইলো সবাই আরোগ্য! শুধু তাঁর কাছেই! নিরুপায়ের একমাত্র উপায় তো তিনিই! নিরুপায় যখন ‘হে আল্লাহ!’ বলে, তখন আল্লাহ্র বলেন : ‘কী হয়েছে আমার বান্দা! বলো, জলদি বলো! আমি হাজির!’ আল্লাহ তখন নিরুপায়কে ফিরিয়ে দেন না। কাফের কিংবা ফাসেক বলে তাকে রাগ করে দূরে ঠেলে দেন না! যে-ই তাঁর দরোজায় হাজির হয় তাকেই তিনি আশ্রয় দেন! তাঁর দরোজা সবার জন্যে খোলা! চির অবারিত! তবে দুনিয়ার কাফের মুশরিকদেরকে তিনি শুধু দুনিয়াই দেন, আখেরাতের কোনো আবদার তিনি রক্ষা করেন না। কেননা, এরা আখেরাতকে বিশ্বাস করে না!

অশ্রুময় ও হৃদয়োৎসারিত প্রার্থনা শেষে দেখা গেলো যে ফোলা ভাবটা অনেকটাই কমে আসছে! বেদনার নীলচে রঙটাও ধীরে ধীরে দূর হয়ে যাচ্ছে! ব্যথাও আগের চেয়ে অনেক কম এবং কমছেই! দু’দিন শেষে পা’টা একেবারেই ভালো হয়ে গেলো!!
রোগী অবাক!
ইদগার অবাক!
মা-বাবা আরো অবাক!
পরিবারের সবাই অবাক!
আর ডাক্তারের চোখ তো একেবারে ছানাবড়া!
সব শোনে এবং সব দেখে সে কোনো হিসাব মেলাতে পারছিলো না!

বন্ধুরা! কী ভাবছো? এ কি কল্পকাহিনী না বাস্তব সত্য? আগেই বলেছি বাস্তব সত্য! কেমন হয়, যদি বলে দিই গল্পের ‘নায়ক’-এর পরিচয়টা? তিনি হলেন দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের মিত্র বাহিনীর সেনাপতি! সুতরাং বুঝতেই পারছো, জগত জোড়া অনেক ছিলো তার খ্যাতি। তার নাম— অ্যাইজেনহাওয়ার (ঊরংবহযড়বিৎ)। তার আরেকটা বড় পরিচয় আছে। পরবর্তীতে তিনি আমেরিকার (৩৪ নাম্বার) প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত হয়েছিলেন। সুতরাং বলতেই হবে— আল্লাহ সবকিছু পারেন। ওষুধের মাধ্যমে তিনি যেমন সুস্থতা দান করতে পারেন তেমনি বিনা ওষুধ ও বিনা চিকিৎসায়ও তিনি আরোগ্য দান করতে পারেন।

আমি ১৩৮২ হিজরীতে রিয়াদ এসেছিলাম। সেখান থেকে পরে মক্কায় চলে এসেছিলাম। মক্কাই তখন হয়ে উঠেছিলো আমার কাজকর্মের কেন্দ্রবিন্দু। রিয়াদে আমার এক বন্ধু ছিলেন। সিরিয়া থেকে এসেছিলেন। তিনি এবং তার মা সেখানে একসঙ্গে থাকতেন। একবার একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে আমার বন্ধুটির লেবানন যাওয়ার প্রয়োজন হলো। কিন্তু মা রাজি হচ্ছিলেন না। ছেলে চলে গেলে এখানে কীভাবে একলা ঘরে থাকবেন তিনি— এ সব ভাবছিলেন তিনি। এ দিকে ছেলে এ-সফরের ব্যাপারে অটল রইলো। যাই হোক; সফরের আগের দিন ছেলে ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে কোম্পানির কাছে তা হস্তান্তর করে বাসায় ফিরে এলেন। ফ্লাইট ছিলো ভোরে।

বাসায় কী ঘুম পেয়েছিলো তারে আল্লাহ মালুম। তিনি জাগলেন না। জাগতে পারলেন না। মা’ও তাকে জাগালেন না। বেশ পরে উঠে দেখেন— বিমান ছাড়ার নির্দ্ধারিত সময় বাকি আছে আর মাত্র পৌনে এক ঘন্টা। এখন তাহলে কী করা? তড়িঘড়ি করে তিনি ছুটলেন বিমানবন্দরের দিকে। যেতে যেতে দু‘আ করতে লাগলেন— বিমানটা যেনো তার পৌঁছার আগে আকাশে ওড়াল না দেয়! গাড়ি খুব দ্রুতই পৌঁছে গেলো বিমানবন্দরে। দেখলেন এখনো বিমান ছাড়তে বাকি আছে আধা ঘন্টা। তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বসলেন পেতে রাখা একটা চেয়ারে। অপেক্ষার নীরব প্রহরে হঠাৎ করেই তিনি হারিয়ে গেলেন আবারো সেই নিদ্রার কোলে।
বিমান ছাড়ার সময় হলো!
মাইকে ঘোষণাও দেয়া হলো!
তার নাম ধরে বারবার ডাকাও হলো!
কিন্তু তিনি উঠলেন না, শুনলেন না! শেষ পর্যন্ত বিমান তাকে রেখেই চলে গেলো!

পরে আমাকে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন :
— আল্লাহ্র কাছে এতো দু‘আ করলাম তিনি যেনো আমাকে বিমানটা মিলিয়ে দেন, তারপরও এমন হলো কেনো?
আমি তাকে সান্ত্বনা দিলাম। বললাম :
— আল্লাহ এমন ব্যক্তির দু‘আ কখনোই ফিরিয়ে দেন না, যে তাঁকে ডাকে হৃদয় থেকে। কিন্তু মানুষ কী উপকারী আর কী অপকারী তার বাছ-বিচার না করেই অনেক সময় দু‘আ করতে থাকে। কী উপকারী তা আল্লাহই অধিক ভালো জানেন।
বন্ধুটি আমার কথা মনে হয় হজম করতে পারেন নি। কিন্তু সেদিন কী ঘটেছিলো, বলবো? সেদিন বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছিলো! আরোহীদের সবাই মারা গিয়েছিলো! বুঝতেই পারছো, আমার বন্ধু যে বিমানটি হারিয়েছিলেন এটিই সেই বিমান! কল্পনা করো তো, এরপর আমার বন্ধু বিমান ফেল করায় কী পরিমাণ শোকর আদায় করেছিলেন?

অনেক সময় মানুষ নিজের জন্যে যা ক্ষতিকর, তাই আল্লাহর কাছে চেয়ে বসে। কিন্তু আল্লাহ তো মহান দয়ালু। তিনি ক্ষতিকর জিনিস তাকে দান করেন না। বাবা শিশুপুত্রকে নিয়ে দোকানে গেলে শিশুপুত্র এটা সেটা কিনতে চায়। তখন বাবা কি তাকে ক্ষতিকর কিছু কিনে দেন? খেলনা চাইলে খেলনা কিনে দেন। কিন্তু লাল প্যাকেটে মোড়ানো কোনো ওষুধ কি কিনে দেবেন ফার্মেসী থেকে? দেবেন না! কারণ তা পুত্রের জন্যে ক্ষতিকর। আল্লাহ তো মা বাবা’র চেয়ে অনেক অনে-ক বেশি দয়ালু! তাহলে তিনি কেনো বান্দাকে ক্ষতিকর জিনিস চাইলেই দিয়ে দেবেন?!
Copy By মুহতারাম শায়েখ Yahya Yusuf Nadwi
লেখক ও বিশিষ্ট শিশু সাহিত্য ও সীরাত গবেষক ও সফল অনুবাদক।

No comments:

Post a Comment