Tuesday, June 28, 2016
ব্লাড মুন ও দাজ্জাল এবং বিশ্ব।
লিখেছেন:Asif Adnan
তার সম্পর্কে আমি তোমাদেরকে সতর্ক করছি। এমন কোন নাবী নেই যিনি তাঁর কাওমকে এ বিষয়ে সতর্ক করেননি। তবে তার সম্পর্কে আমি তোমাদের এমন একটি কথা বলব যা কোন নাবীই তাঁর জাতিকে বলেননি। তা হল যে, সে কানা হবে আর আল্লাহ্ অবশ্যই কানা নন।
[বুখারী শরীফ]
.
.
“দাজ্জাল ততক্ষণ পর্যন্ত বের হবে না, যতক্ষণ না মানুষ তার কথা ভুলে যাবে, মিম্বর থেকে দাজ্জালের আলোচনা উঠে যাবে।”
[মাজমা আল যাওয়াইদী]
.
.
গত সপ্তাহের চাঁদ আসলেই অন্যরকম ছিল। না, আমি শুধু ব্লাড মুনের রক্তাভ আভার কথা বলছি না। ২৮ তারিখের চাঁদটা দেখতে সাধারণের চাইতে একটু বড় ছিল, এজন্যও বলছি না। ব্লাড মুন মোটামুটি রেয়ার একটা ঘটনা হলেও, সেপ্টেম্বর ২৮ এর ব্লাড মুন ছিল গত ১৮ মাসে চতুর্থ ব্লাড মুনের ঘটনা। প্রথম দুটি ছিল, ছিল গত বছরের এপ্রিলের ১৫ ও অক্টোবরের ৮ তারিখ। সেপ্টেম্বরের ২৮ তারিখের আগে, এই বছরেরই এপ্রিলের ৪ তারিখ আবারো ব্লাড মুন দেখা দেয়। ছয় মাস পর পর ৪ টি ব্লাড মুনের এই সাইকেলকে বলা হয় টেট্র্যাড (Tetrad)। টেট্র্যাড ব্লাড মুনের চাইতেও রেয়ার।
.
.
মুসলিমদের মতো ইহুদীরাও বছরকে চান্দ্র মাসে ভাগ করে হিসেব করে। ইহুদীদের কিতাবাদি এবং আলেমদের মতে, ব্লাড মুন ইহুদিদের জন্য অমঙ্গল বয়ে আনে। তবে, যদি ব্লাড মুনগুলো কোন ইহুদী ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দিনে হয়, তবে সেটা তাদের জন্য কল্যান বয়ে আনবে। গত পাঁচশ বছরে মাত্র চারবার ব্লাড মুন টেট্র্যাড ইহুদিদের ধর্মীয় উৎসব বা অনুষ্ঠানের সাথে মিলে গেছে। এটি প্রথমবার ঘটে ১৪৯২ সালে। ইতিহাস বইগুলোতে ১৪৯২ সাল ক্রিস্টফার কলম্বাসের আমেরিকা আবিস্কারের জন্য প্রসিদ্ধ। কিন্তু অনেকেই জানেন না, স্পেনের রাজা ফারডিন্যান্ড এবং রানী ইসাবেলা, ১৪৯২ সালে স্পেন থেকে প্রায় দুই লক্ষ ইহুদীকে বহিস্কার করেন। রাতারাতি উদ্বাস্তু বনে যাওয়া এই ইহুদীরা একটি নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পায় নব আবিষ্কৃত আমেরিকায়।সম্ভাব্য একটি ট্র্যাজিডি থেকে বেঁচে যায় ইহুদীরা।
.
.
পরের বার টেট্র্যাড ব্লাড মুনের তারিখ ইহুদিদের ধর্মীয় উৎসবের দিনের সাথে মিলে যায় ১৯৪৮ সালে। আমাদের মুসলিমদের কাছে ১৯৪৮ সালটা অপমানের এবং পরাজয়ের। ইহুদীদের কাছে ১৯৪৮ এক মহান বিজয়ের বছর। এই বছর পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিনে অসংখ্য নিরীহ মুসলিমের রক্ত আর পুরো মুসলিম উম্মাহর স্বপ্নের ধ্বংসাবশেষের উপর প্রতিষ্ঠিত হয় যায়নিস্ট “স্টেইট অফ ইস্রায়েল”।
.
.
১৯৬৭ ছিল টেট্র্যাড ব্লাড মুন আর বানী ইস্রাইলের উৎসবের দিনক্ষণ মিলে যাবার পরের বছর। এই বছর জুনের ৭ তারিখ, হাজার বছর অপেক্ষার পর, “ছয় দিনের যুদ্ধের” মাধ্যমে ইহুদীরা জেরুসালেম এবং টেম্পল মাউন্টের (ইনক্লুডিং মাসজিদুল আকসা) নিয়ন্ত্রন ফিরে পায়। ইহুদীরা বিশ্বাস করে সুলাইমান আলাহিস সালাম এর বানানো মাসজিদের (তাদের ভাষায় টেম্পল) জায়গাতেই মেসায়াহ তৃতীয় মন্দির পুনঃনির্মাণ করবে।
.
.
টেট্র্যাডের চারটির মধ্যে আর বাকি থাকে একটি। সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৫ ছিল সেই চতুর্থ ব্লাড মুন। ১৪৯২, ১৯৪৮, ১৯৬৭ এই তিনটি বছরই বানী ইস্রাইলের জন্য অত্যন্ত কল্যাণময় (অন্তত বাহ্যিক দৃস্টি ও পার্থিব বিচারে) বছর ছিল। কিন্তু বর্তমানে ইস্রাইলের অবস্থাটা কেমন যেন গোলমেলে। সুস্পষ্ট কোন সাফল্যের আভাস এখনো দেখা যাচ্ছে না। বরং এ বছরে কয়েক বার জেরুসালেমেই ইহুদীদের সিন্যাগগে হামলা হয়েছে। ইহুদীদের উপর খোলা রাস্তাতেও ফিলিস্তিনী সিভিলিয়ানরা কিছু আক্রমন চালিয়েছেন। অবশ্য ইস্রাইল এসব কিছুর মধ্যে দিয়েই নিয়মিত মুসলিমদের পাইকারী হারে হত্যা করে যাচ্ছে। হিজাব না খোলার জন্য রাস্তায় গুলি করে মারছে, বাসার ভেতর ঢুকে মুসলিমদের হত্যা করছে, কোলের শিশুকে আগুনে পুড়িয়ে মারছে, ইত্যাদি। তবে এগুলো নিয়মের ব্যতিক্রম না। ইহুদী নিয়ন্ত্রিত ফীলিস্তিনে, গত প্রায় সত্তর বছর ধরে মুসলিমদের সাথে এরকমই হয়ে আসছে।
.
.
মুসলিমদের এভাবে হত্যা করা, তাদের উপর যুলুম করা এটা ইস্রাইলে ইহুদীদের দৈনন্দিন রুটিনের অংশ। এখানে কোন মহাসাফল্য আপাতত দেখা যাচ্ছে না। রিসেন্টলি ইহুদীরা আল-আকসার ব্যাপারে কিছুটা হার্ড লাইনে গেছে। বেশ কয়েক বার সশস্ত্র যায়োনিস্টরা পবিত্র আল-আকসার কম্পাউন্ডে ঢুকেছে। মাসজিদের খাদেম এবং মুসল্লীদের সাথে তাদের সংঘর্ষ হয়েছে। আল আকসা নিয়ে তারা আরেকটু অ্যাগ্রেসিভ হয়েছে। কিন্তু এটাকেও ঠিক ঐভাবে বিশাল কোন সাফল্য বলা যায় না। চিন্তা করুন, ১৪৯২ সালে তারা মোটামুটী নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বলা যায় এরকরম “আলৌকিক” ভাবে বেঁচে গেল। ১৯৪৮ এ মিলেনিয়া পর, দেশে দেশে বিতাড়িত জীবন যাপনের পর “এরেটয ইস্রাইল/ল্যান্ড অফ ইস্রাইলে” তারা ফেরত আসলো। ১৯৬৭ সালে হাজার বছরে প্রথম বারের মত জেরুসালেমের উপর তাদের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হল।
.
.
প্রতিবারই টেট্র্যাড ব্লাড মুনের তারিখ মিলে গিয়েছিল তাদের কোন উৎসব বা অনুষ্ঠানের দিনের সাথে। এবছরের সেপ্টেম্বরের ২৮ তারিখেও তাই হয়েছে। ২৮শে সেপ্ট
Thursday, June 16, 2016
ফেরা -একজন কট্টর নাস্তিক থেকে আস্তিক
কট্টর নাস্তিক রুবেনের সোজা জবাব ছিলো, মুসলমানরা জঙ্গী সন্ত্রাসী, ওই ধর্মকে গ্রহণ করার কোনো প্রশ্নই আসেনা।
অস্ট্রেলিয়ার তরুণ রুবেন জানান, তার বাবা মা তাকে শিখিয়েছেন আমরা প্রাকৃতিক নিয়মে জন্ম নিয়েছি, এই প্রাকৃতিক নিয়মগুলি প্রাকৃতিক ভাবেই ছিল আর প্রাকৃতিক ভাবেই থাকবে। প্রকৃতি নিজেকে স্রষ্টা দাবি করেনা, এমনি এমনিই নিয়মগুলি হয়েছে, এমনি এমনিই পানি থেকে জীবন এসেছে, এতে কোনো স্রষ্টা লাগেনি, তাই স্র্রষ্টা নেই। আবার একদিন আমরা এমনি এমনিই মরে যাবো, প্রকৃতির অংশ হয়ে যাবো, মরার পরে কোনো কোর্ট কাচারী নেই, এসব বাজে কথা।
বাবাকে বললাম, চাঁদে পানি থাকবেনা কিন্তু পৃথিবীর তিন চতুর্থাংশ পানি থাকবে, অথচ সবগুলিই গ্রহ উপগ্রহ। আবার বিমান দুর্ঘটনায় সবাই মরে যায়, একটা শিশু বেঁেচ থাকে, অথচ সবাই বাঁচতে চেয়েছিলো। এটা প্রকৃতি কিভাবে সিদ্ধান্ত নেয় আর কে তা ডিজাইন করে ? বাবা বললেন এমনি এমনিই হয় ।
বাবার কথায় আমি কট্টর নাস্তিক ছোটবেলা থেকে। ঈশ্বর বিহীন জগতে বাবাকে ঈশ্বরের মত ভাবতাম, কিন্তু তিনি আমার মাকে ছেড়ে চলে গেলেন, প্রথম ধাক্কা খেলাম জীবনে, এটাও কি এমনি এমনি প্রাকৃতিক নিয়ম, তাহলে আমার বন্ধুর পিতা মাতা এত সুখী কেন ?
মাত্র ১৮ বছর বয়সে আমার সেই বন্ধুটিও এমনি এমনিই মরে গেলো, কি আজব মরণ, মনে হলো বেড়ে দেয়া গরম ভাত দুই মিনিটে ঠান্ডা হয়ে গেছে, তার জীবনটা সে শুরুই করতে পারেনি, এমনি এমনি এত সহজে প্রকৃতি তাকে নিয়ে গেলো ? ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রির ফর্মুলার মতো অক্সিজেন আর হাইড্রজেন মিলালে যদি পানি হয়, মানুষের জীবন কেন একই ধরনের প্রাকৃতিক ফর্মুলায় চলেনা ?
কেউ ধনী অথচ অসুখী আর গরীব অথচ সুখী, কিন্তু ফর্মুলা অনুযায়ী সব ধনীর সুখী থাকার কথা। পদার্থের ফর্মুলার জগত আর মানুষের ফর্মুলার জগতে পার্থক্য কেন ? এমনি এমনি ? এই প্রকৃতির মাঝে একটা কন্ট্রোল রুম না থাকলে এরকম তো হওয়ার কথা নয়।
কোনো জবাব নেই আমার কাছে-কেন আমি, কে আমি, কোথায় আমি? প্রকৃতির সব প্রাণী একরকম মানুষ শুধু অন্যরকম, এটি কি এমনি এমনি হয়েছে ? ড্রিংকস করতে শুরু করলাম, পুলিশেও ধরলো। একজন তরুণের জীবনের কঠিন হতাশা আমাকে চেপে ধরলো।
মৃত বন্ধুটির কথা প্রায়ই মনে হতো। ভাবতাম আমি যদি কাল ওর মতই মরে যাই তাহলে কি হবে ? কিছুই না! সাত বিলিয়ন লোকের পৃথিবীতে আমার পরিচিত মুষ্টিমেয় কয়েকজন মাত্র জানবে ছেলেটি মরে গেছে। কিন্তু মানব জীবন কি কুকুর বিড়ালের মৃত্যুর মতো এতই ছোট, এতই অর্থহীন, উদ্দেশ্য বিহীন হতে পারে ? আমার অস্তিত্বের মধ্যে এক আজব শূন্যতা অনুভব করতে শুরু করলাম। তখন মনে হলো বাবার শেখানো প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে অবশ্যই মানুষের জন্যে কিছু একটা আছে, থাকতেই হবে। তা না হলে মানুষেরা আলাদা কেন ? শুধু মানুষকে যা খুশী ভাবার বুদ্ধি আর যুক্তি বোঝার মন দেয়া হলো কেন ? আর সব প্রাণীর বুদ্ধি আছে হয়তো কিন্তু যুক্তি বোঝেনা কেন ?
মনে হলো মানুষের এই অসহায় শুন্যতা পূরণের জন্যে হয়তো ধর্মের উদ্ভব হয়েছে। আমার অসহায়ত্ব আর একাকীত্ব ঘুচানোর জন্যে ভাবলাম ধর্মকে ব্যবহার করে দেখি।
অস্ট্রলিয়ান হিসাবে সোজা খ্রিস্ট ধর্মকেই ধরলাম। ভাবলাম গাড়ির কাঁচে স্টিকার লাগাবো, ‘আই লাভ জেসাস’ তারপরে নিষিদ্ধ জায়গায় পার্কিং করে জরিমানা না খেলে ভাববো ঈশ্বর আছেন। খ্রিস্ট ধর্মের সব গ্রুপের বিশ্বাস নিয়ে পড়াশুনা করলাম,পন্ডিতদের সাথে বসলাম-আমার জবাব মিললোনা, তাদের কথাবার্তা ভালো ছিলো, কিন্তু মনে হয়নি তারা আমার শুন্যতা পূরণের উপযোগী ধর্মের কথা বলছেন।
অবাক লাগলো, ঈশ্বর তার অলৌকিক সন্তানকে দুনিয়াতে পাঠিয়ে অসহায় ভাবে তার পুত্রকে ক্রুসিফাই করালেন, তাতে বাকি সবাই পাপমুক্ত হয়ে গেলো। আবার পবিত্র আত্মার উপস্থিতি পিতা পুত্রের মাঝখানে, সবাই ঈশ্বর পার্টনার। ঈশ্বর একাই তো যথেষ্ঠ হওয়া উচিত, যদি উনি ঈশ্বর হয়ে থাকেন। ঈশ্বর কেন আমার বাবার মতো সংসার পেতে বসবেন আর আমাকে যখন ঝুলাচ্ছে তখন চুপ করে দেখবেন, যৌক্তিক লাগলোনা। মনে হলো অযৌক্তিক কথা-বার্তার কারণেই গীর্জাগামীদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
হিন্দু ধর্ম দেখলাম। আমার কাজের জায়গায় হিন্দু সহকর্মীরা ছিলো, আমরা ধর্ম নিয়ে সারাক্ষণ কথা বলতাম, আমি ঝগড়া করতামনা কারণ ওরা ভালো বন্ধুও ছিলো। ওরা বলতো তোমার সম্পদের ব্যাপারে একজন দেবতাকে বিশ্বাস করতে হবে, আবার বিদ্যার ব্যাপারে আর একজন দেবতাকে, এভাবে সব প্রয়োজনের জন্যে আলাদা আলাদা দেবতাকে বিশ্বাস করতে হবে। আমি তখন বলতাম, কাম অন ম্যান, দেবতাদের মধ্যে যদি ডিপার্টমেন্টাল তর্ক লেগে যায়, তখন কি হবে ?
ইহুদী ধর্ম দেখলাম, নতুন কিছু পেলামনা। বুদ্ধকে ভালো লাগলো। কিন্তু গৌতম বুদ্ধ নিজের সম্মন্ধে যা বলেছেন তাতে একজন প্রেরিত পুরুষের মত কোনো কথা নেই। আমার যে মৌলিক প্রশ্ন, ‘আমি কেন পৃথিবীতে এসেছি’-তার কোনো জবাব পেলামনা এই ধর্মে, অথচ অনেক সুন্দর কথা আছে।
তখন আমার এক খ্রিস্টান বন্ধু বলল, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে দেখো ।
নাহ ম্যান, ওরা তো সন্ত্রাসী! আমি কোনো মসজিদের ধারে কাছে যাবো না, কখনো-ই না। কিন্তু কদিন পরে আমি কেন জানিনা প্রেস্টন এলাকার মসজিদের সামনে নিজেকে আবিষ্কার করলাম। মসজিদে ঢুকে পড়লাম পায়ের জুতো না খুলেই। এ সময় এক ব্যক্তি নামাজ পড়ছিলেন ও সিজদারত অবস্থায় ছিলেন। আমি সরাসরি তার কাছে গিয়ে দাঁড়াই। আমি তার নামাজ পড়ার দৃশ্য দেখতে লাগলাম। এ অবস্থায় মসজিদের আলেম আবু হামজাহ হাসিমুখে আমাকে স্বাগত জানাতে এলেন ও তার কার্যালয়ে আমন্ত্রণ জানালেন। সেখানে আমি স্রষ্টা ও ইসলাম সম্পর্কে যখন নানা প্রশ্ন করছিলাম তখন তিনি জবাব দিচ্ছিলেন শুধু কোরানের উদ্ধৃতি দিয়ে।
এরপর যতবারই আমি যাকেই প্রশ্ন করেছি কেউ তার মন থেকে নিজস্ব কোনো জবাব দেয়নি, সবাই আমার হাতে কোরান ধরিয়ে বলত এই দেখো তোমার প্রশ্নের উত্তর আল্লাহ এভাবে দিয়েছেন। অথচ আমি যখন পাদ্রীদের কাছে যেতাম বাইবেল দেখিনি কখনো। তারা তাদের নিজস্ব যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করতেন। দু-একজন দু-একবার বাইবেল পড়ে উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন অবশ্যই। কিন্তু প্রতিটি মসজিদে আমি যখনই প্রশ্ন নিয়ে গিয়েছি, জবাবে তারা কোরান নিয়ে এসেছেন ।
আমি পরিস্কার বুঝে গেলাম, ইসলাম ধর্মকে তার অনুসারীদের প্রশ্নবোধক কার্য্যকলাপ দেখে বোঝা যাবেনা। ইসলাম আসলে একটি গাইড বই, যে এটি অনুসরণ করছে ঠিকঠাক সে ইসলামে ঢুকে গেছে, তার নাম হয় মুসলিম। আর যে অনুসরণ করছেনা তার নাম আর পাসপোর্টে মুসলিম লেখা থাকলেও সে তা নয় প্রকৃত পক্ষে।
এই সত্য অনুধাবন করার পর আমি কোরান পড়তে শুরু করি, ৬-৭ মাস অধ্যয়ন করার পর আমার মাথায় অনেক প্রশ্ন হাজির হয়, তখন আমার বয়স ২০।
এইরকম বয়সে আমি কিভাবে মুসলমান হলাম, সে এক অদ্ভুত হাস্যকর কাহিনী।
একদিন রাতে আমার কয়েকজন অস্ট্রলিয়ান বন্ধু বড় অক্ষরে ছাপানো এক খন্ড কোরানুল করিম দিলো। আমার কাছে ছোট অক্ষরের কোরান আগেও ছিলো। সেদিন রাতে কেন জানি আমি বিছানায় বসলাম সেই কোরান খন্ড হাতে নিয়ে। পাশে জ্বালালাম একটি মোমবাতি। জানালা খুলে দিলাম। গ্রীষ্ম কালের একটি সুন্দর সোনালী সন্ধ্যা। আবহাওয়া চমৎকার, চারিদিক নির্জন। একটা পবিত্র অনুভুতি অনুভব করছিলাম, অতি সুন্দর।
কোরান পড়া শুরু করলাম অন্যান্য রাতের মতো আর ভাবনা গুলো খেলতে শুরু করলো মাথার ভেতরে। মনে হলো বইটিতে ঠিক সেই কথাগুলিই লেখা আছে যা একজন সৃষ্টি কর্তার তরফ থেকে হওয়া উচিত। আবার এক ধরনের দ্বন্দও কাজ করছিলো, কি জানি হয়ত ঈশ্বরই নেই, আমি ঠিক বোঝাতে পারবোনা, আমার কারো সহায়তা দরকার ছিল তখন ধাতস্ত হতে, আমি কোরান হাতে ধরে সোজা হয়ে বসলাম।
বললাম ও ঈশ্বর, তুমি যদি থেকেই থাকো আমাকে একটা চিহ্ন দেখাওতো, ভালো বা বড় কিছু। যেমন ধরো এই গরমে এখানে বজ্রপাত হয়না, এখন তুমি যদি আকাশ ফাটিয়ে প্রচন্ড শব্দে একটা ফেলে দাও, আমি বুঝব তুমি আছ। অথবা নিঃশ্বব্দে একটা বিদ্যুৎ চমক দেখাও আকাশের দিগন্তে আলোক ছটা নিয়ে, যদি তুমি এরকম শোনাও বা দেখাও-আমি তোমার, তোমারই গোলাম হয়ে যাবো, কথা দিলাম ।
আকাশে তারা ছাড়া আর কোনো আলো নেই, বজ্রপাত তো দুরের কথা জেট বিমানেরও কোনো শব্দও এলোনা।
ঠিক আছে অসময়ে বজ্রপাতের জন্যে হয়তো তুমি রাজি নও ঈশ্বর, তাহলে মটমট করে একটা ডাল বা কোনো কিছু ভাঙ্গার শব্দ শোনাওনা। কিছু কানে এলোনা।
ঠিক আছে ঈশ্বর, আমার সামনে যে মোমবাতিটি জ্বলছে তার শিখাতে একটা বিস্ফোরণ ঘটাও দুই ফুট উচু সিনেমায় যেমন দেখায়, আমি মুগ্ধ হয়ে তোমাকে বিশ্বাস করবো। মোমবাতি মিটমিট করেই জ্বলতে রইলো।
আমি অপেক্ষায় অথচ কিছু ঘটছেনা একটু হতাশা আর গোস্বা অনুভব করলাম। বললাম ঈশ্বর, তুমি নিজেকে সবচেয়ে শক্তিশালী দাবি করো অথচ আমাকে তোমার কোনো চিহ্ন দেখাতে পারলে না! ঠিক আছে আমি তোমাকে আর একটা সুযোগ দিচ্ছি, বজ্রপাতটি একটু বেশি চাওয়া হয়ে গেছে, সব সময় যা হয় সেরকম কিছু করাও, একটা গাড়ীকে লম্বা হর্ন দিয়ে রাস্তা দিয়ে পার করাও, আমি এত ছোট কিছু চাইছি তোমাকে বিশ্বাস করার জন্যে। ধরে নেবো এটাই আমার জন্যে তুমি আছ তার চিহ্ন ঠিক আছে ?
অবাক কান্ড, ঈশ্বর একটা ট্যাক্সিও খুজে পেলেন না যেটা হর্ন দেয় ! মনটা খারাপ হলো, চুপ মেরে আছি। মনে হলো আমি মহাশুন্যের নিস্তবদ্ধতায় বসে আছি, একটি পিপড়ার পদশব্দও শুনছি না, আমি একটু ভেঙ্গেই পড়লাম, ভেবেছিলাম আজকের এই মুহুর্তটিতে আমি কিছু একটা খুঁজে পাবো, যা ঈশ্বর থাকার নিদর্শন। না কিছু হলনা।
হতাশ হয়ে অলস ভঙ্গীতে কোরান হাতে উঠিয়ে পৃষ্ঠা উল্টাতেই চোখ আটকে গেলো একটি আয়াতের দিকে, “বিশ্বাসীদের জন্যে আকাশ ও পৃথিবীতে নিদর্শন রয়েছে। তোমাদের সৃষ্টিতে আর চারদিকে ছড়িয়ে রাখা জীব-জন্তুর সৃজনের মধ্যেও নিদর্শনাবলী রয়েছে। দিন ও রাতের পরিবর্তনে আর বৃষ্টির পরে পৃথিবীকে তার মৃত্যুর পর আবার জীবিত করা হয়, তার মধ্যে আর বায়ুর পরিবর্তনে, এসবই তো নিদর্শন’। (৪৫:৩-৫)
হটাৎ মর্মে অনুধাবন হলো ছোট বেলা বাবা বলেছিলেন, এমনি এমনি হয় প্রাকৃতিক নিয়মগুলি, আমার বোঝা হয়ে গেল এমনি এমনি কিছু হয়না তাতে একজন ডিজাইনার লাগে, তিনি আমাকে তার উপস্থিতি জানিয়েছেন। আমি মুসলিম হবো।
পরদিন সন্ধ্যায় রমজানের প্রথম রাতে আমি যখন মসজিদে অপেক্ষা করছিলাম, আর অসংখ্য মুসলমান তারাবী নামাজ পড়ছিল তখনও এক ধরনের ভয় কাজ করছিলো মনের ভেতর, কিন্তু যখন শেখ ফাহমী আমাকে সত্যই শাহাদা পড়াচ্ছিলেন, কোথায় চলে গেলো সব দ্বিধা, মনে হলো কাদেরকে ভাবতাম এতোদিন জঙ্গী সন্ত্রাসী। মনে হচ্ছিলো আমি একা কোথাও দাঁড়িয়ে, মাথার ওপর গড়িয়ে পড়ছে ঠান্ডা জল, অদ্ভূত এক পবিত্র স্নানে নির্মল হয়ে উঠছে আমরা সর্বাঙ্গ, তনু-মন। সব ভায়েরা আমাকে আলিঙ্গন করে যাচ্ছে মায়া আর ভালবাসার স্পর্শ নিয়ে। আমি প্রস্ফুটিত হয়ে উঠছি।
১৯৯৬ সনে রুবেন মাত্র ২০ বছর বয়সে আবু বকর নাম ধারণ করেন আর বলেন, পশ্চিমারা ধর্মান্তরিত হলে বলে কনভার্ট, মানুষ যখন ইসলাম ধর্মে ঢোকে সে কনভার্ট নয় সে হয় রিভার্ট, যিনি ফিরে আসেন। মুসলিম কোনো নাম নয়, মুসলিম একটি ক্রিয়াপদ, ভার্ব। আমার বাসার পেছনে যে বড় গাছটি আছে সে আল্লাহর হুকুম পালন করছে, আল্লাহ তাকে যা নির্দেশ দিয়েছেন তাই মেনে চলছে। গাছটি আমার কাছে মুসলিম। সে আল্লাহর ইচ্ছার কাছে নিজেকে সঁপে দিচ্ছে।
যখন একটি বাচ্চার জন্ম হয় তখন ক্ষুধা লাগলে কাঁদে, সব বাচ্চারাই কাঁদে, এই প্রাকৃতিক নিয়ম সে আল্লাহর ডিজাইনে করে। সে তখন মুসলিম। যখন সে বড় হয় তখন সে অন্যদের কাছ থেকে নতুন কিছু শিখে এবং অন্যের আদর্শকে অনুসরণ করে মুসলিম থেকে সরে যায়। পরবর্তী সময়ে সে যদি ফিরে আসতে চায় সে রিভার্ট করছে নিজেকে, কনভার্ট নয়। কারণ আল্লাহ বলেছেন, আমি সব শিশুকে মুসলিম হিসেবে জন্ম দেই।
আমি ফিরে এসেছি মানুষের জন্যে এক অফুরন্তজীবনের উৎসে, আমি একজন মুসলিম, বাকিরাও তাই ছিলো, তারাও আসবে একদিন ফিরে ।
‘হে মানুষ, আমি তোমাদের এক পুরুষ আর এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি, পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পারো। তোমাদের মধ্যে সে-ই আল্লাহর কাছে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন যে বেশি সাবধানী। আল্লাহ সব কিছু জানেন, সব খবর রাখেন।’ (৪৯:১৩ )
– লিখেছেন আবু বকর
(তিনি একজন মনস্তত্ববিদ এবং একজন ফিল্ম-মেকার। প্রেস্টন ভিক্টোরিয়াতে তার নিবাস – “আমাদের সময়” পত্রিকায় তার এ লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে )
অস্ট্রেলিয়ার তরুণ রুবেন জানান, তার বাবা মা তাকে শিখিয়েছেন আমরা প্রাকৃতিক নিয়মে জন্ম নিয়েছি, এই প্রাকৃতিক নিয়মগুলি প্রাকৃতিক ভাবেই ছিল আর প্রাকৃতিক ভাবেই থাকবে। প্রকৃতি নিজেকে স্রষ্টা দাবি করেনা, এমনি এমনিই নিয়মগুলি হয়েছে, এমনি এমনিই পানি থেকে জীবন এসেছে, এতে কোনো স্রষ্টা লাগেনি, তাই স্র্রষ্টা নেই। আবার একদিন আমরা এমনি এমনিই মরে যাবো, প্রকৃতির অংশ হয়ে যাবো, মরার পরে কোনো কোর্ট কাচারী নেই, এসব বাজে কথা।
বাবাকে বললাম, চাঁদে পানি থাকবেনা কিন্তু পৃথিবীর তিন চতুর্থাংশ পানি থাকবে, অথচ সবগুলিই গ্রহ উপগ্রহ। আবার বিমান দুর্ঘটনায় সবাই মরে যায়, একটা শিশু বেঁেচ থাকে, অথচ সবাই বাঁচতে চেয়েছিলো। এটা প্রকৃতি কিভাবে সিদ্ধান্ত নেয় আর কে তা ডিজাইন করে ? বাবা বললেন এমনি এমনিই হয় ।
বাবার কথায় আমি কট্টর নাস্তিক ছোটবেলা থেকে। ঈশ্বর বিহীন জগতে বাবাকে ঈশ্বরের মত ভাবতাম, কিন্তু তিনি আমার মাকে ছেড়ে চলে গেলেন, প্রথম ধাক্কা খেলাম জীবনে, এটাও কি এমনি এমনি প্রাকৃতিক নিয়ম, তাহলে আমার বন্ধুর পিতা মাতা এত সুখী কেন ?
মাত্র ১৮ বছর বয়সে আমার সেই বন্ধুটিও এমনি এমনিই মরে গেলো, কি আজব মরণ, মনে হলো বেড়ে দেয়া গরম ভাত দুই মিনিটে ঠান্ডা হয়ে গেছে, তার জীবনটা সে শুরুই করতে পারেনি, এমনি এমনি এত সহজে প্রকৃতি তাকে নিয়ে গেলো ? ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রির ফর্মুলার মতো অক্সিজেন আর হাইড্রজেন মিলালে যদি পানি হয়, মানুষের জীবন কেন একই ধরনের প্রাকৃতিক ফর্মুলায় চলেনা ?
কেউ ধনী অথচ অসুখী আর গরীব অথচ সুখী, কিন্তু ফর্মুলা অনুযায়ী সব ধনীর সুখী থাকার কথা। পদার্থের ফর্মুলার জগত আর মানুষের ফর্মুলার জগতে পার্থক্য কেন ? এমনি এমনি ? এই প্রকৃতির মাঝে একটা কন্ট্রোল রুম না থাকলে এরকম তো হওয়ার কথা নয়।
কোনো জবাব নেই আমার কাছে-কেন আমি, কে আমি, কোথায় আমি? প্রকৃতির সব প্রাণী একরকম মানুষ শুধু অন্যরকম, এটি কি এমনি এমনি হয়েছে ? ড্রিংকস করতে শুরু করলাম, পুলিশেও ধরলো। একজন তরুণের জীবনের কঠিন হতাশা আমাকে চেপে ধরলো।
মৃত বন্ধুটির কথা প্রায়ই মনে হতো। ভাবতাম আমি যদি কাল ওর মতই মরে যাই তাহলে কি হবে ? কিছুই না! সাত বিলিয়ন লোকের পৃথিবীতে আমার পরিচিত মুষ্টিমেয় কয়েকজন মাত্র জানবে ছেলেটি মরে গেছে। কিন্তু মানব জীবন কি কুকুর বিড়ালের মৃত্যুর মতো এতই ছোট, এতই অর্থহীন, উদ্দেশ্য বিহীন হতে পারে ? আমার অস্তিত্বের মধ্যে এক আজব শূন্যতা অনুভব করতে শুরু করলাম। তখন মনে হলো বাবার শেখানো প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে অবশ্যই মানুষের জন্যে কিছু একটা আছে, থাকতেই হবে। তা না হলে মানুষেরা আলাদা কেন ? শুধু মানুষকে যা খুশী ভাবার বুদ্ধি আর যুক্তি বোঝার মন দেয়া হলো কেন ? আর সব প্রাণীর বুদ্ধি আছে হয়তো কিন্তু যুক্তি বোঝেনা কেন ?
মনে হলো মানুষের এই অসহায় শুন্যতা পূরণের জন্যে হয়তো ধর্মের উদ্ভব হয়েছে। আমার অসহায়ত্ব আর একাকীত্ব ঘুচানোর জন্যে ভাবলাম ধর্মকে ব্যবহার করে দেখি।
অস্ট্রলিয়ান হিসাবে সোজা খ্রিস্ট ধর্মকেই ধরলাম। ভাবলাম গাড়ির কাঁচে স্টিকার লাগাবো, ‘আই লাভ জেসাস’ তারপরে নিষিদ্ধ জায়গায় পার্কিং করে জরিমানা না খেলে ভাববো ঈশ্বর আছেন। খ্রিস্ট ধর্মের সব গ্রুপের বিশ্বাস নিয়ে পড়াশুনা করলাম,পন্ডিতদের সাথে বসলাম-আমার জবাব মিললোনা, তাদের কথাবার্তা ভালো ছিলো, কিন্তু মনে হয়নি তারা আমার শুন্যতা পূরণের উপযোগী ধর্মের কথা বলছেন।
অবাক লাগলো, ঈশ্বর তার অলৌকিক সন্তানকে দুনিয়াতে পাঠিয়ে অসহায় ভাবে তার পুত্রকে ক্রুসিফাই করালেন, তাতে বাকি সবাই পাপমুক্ত হয়ে গেলো। আবার পবিত্র আত্মার উপস্থিতি পিতা পুত্রের মাঝখানে, সবাই ঈশ্বর পার্টনার। ঈশ্বর একাই তো যথেষ্ঠ হওয়া উচিত, যদি উনি ঈশ্বর হয়ে থাকেন। ঈশ্বর কেন আমার বাবার মতো সংসার পেতে বসবেন আর আমাকে যখন ঝুলাচ্ছে তখন চুপ করে দেখবেন, যৌক্তিক লাগলোনা। মনে হলো অযৌক্তিক কথা-বার্তার কারণেই গীর্জাগামীদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
হিন্দু ধর্ম দেখলাম। আমার কাজের জায়গায় হিন্দু সহকর্মীরা ছিলো, আমরা ধর্ম নিয়ে সারাক্ষণ কথা বলতাম, আমি ঝগড়া করতামনা কারণ ওরা ভালো বন্ধুও ছিলো। ওরা বলতো তোমার সম্পদের ব্যাপারে একজন দেবতাকে বিশ্বাস করতে হবে, আবার বিদ্যার ব্যাপারে আর একজন দেবতাকে, এভাবে সব প্রয়োজনের জন্যে আলাদা আলাদা দেবতাকে বিশ্বাস করতে হবে। আমি তখন বলতাম, কাম অন ম্যান, দেবতাদের মধ্যে যদি ডিপার্টমেন্টাল তর্ক লেগে যায়, তখন কি হবে ?
ইহুদী ধর্ম দেখলাম, নতুন কিছু পেলামনা। বুদ্ধকে ভালো লাগলো। কিন্তু গৌতম বুদ্ধ নিজের সম্মন্ধে যা বলেছেন তাতে একজন প্রেরিত পুরুষের মত কোনো কথা নেই। আমার যে মৌলিক প্রশ্ন, ‘আমি কেন পৃথিবীতে এসেছি’-তার কোনো জবাব পেলামনা এই ধর্মে, অথচ অনেক সুন্দর কথা আছে।
তখন আমার এক খ্রিস্টান বন্ধু বলল, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে দেখো ।
নাহ ম্যান, ওরা তো সন্ত্রাসী! আমি কোনো মসজিদের ধারে কাছে যাবো না, কখনো-ই না। কিন্তু কদিন পরে আমি কেন জানিনা প্রেস্টন এলাকার মসজিদের সামনে নিজেকে আবিষ্কার করলাম। মসজিদে ঢুকে পড়লাম পায়ের জুতো না খুলেই। এ সময় এক ব্যক্তি নামাজ পড়ছিলেন ও সিজদারত অবস্থায় ছিলেন। আমি সরাসরি তার কাছে গিয়ে দাঁড়াই। আমি তার নামাজ পড়ার দৃশ্য দেখতে লাগলাম। এ অবস্থায় মসজিদের আলেম আবু হামজাহ হাসিমুখে আমাকে স্বাগত জানাতে এলেন ও তার কার্যালয়ে আমন্ত্রণ জানালেন। সেখানে আমি স্রষ্টা ও ইসলাম সম্পর্কে যখন নানা প্রশ্ন করছিলাম তখন তিনি জবাব দিচ্ছিলেন শুধু কোরানের উদ্ধৃতি দিয়ে।
এরপর যতবারই আমি যাকেই প্রশ্ন করেছি কেউ তার মন থেকে নিজস্ব কোনো জবাব দেয়নি, সবাই আমার হাতে কোরান ধরিয়ে বলত এই দেখো তোমার প্রশ্নের উত্তর আল্লাহ এভাবে দিয়েছেন। অথচ আমি যখন পাদ্রীদের কাছে যেতাম বাইবেল দেখিনি কখনো। তারা তাদের নিজস্ব যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করতেন। দু-একজন দু-একবার বাইবেল পড়ে উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন অবশ্যই। কিন্তু প্রতিটি মসজিদে আমি যখনই প্রশ্ন নিয়ে গিয়েছি, জবাবে তারা কোরান নিয়ে এসেছেন ।
আমি পরিস্কার বুঝে গেলাম, ইসলাম ধর্মকে তার অনুসারীদের প্রশ্নবোধক কার্য্যকলাপ দেখে বোঝা যাবেনা। ইসলাম আসলে একটি গাইড বই, যে এটি অনুসরণ করছে ঠিকঠাক সে ইসলামে ঢুকে গেছে, তার নাম হয় মুসলিম। আর যে অনুসরণ করছেনা তার নাম আর পাসপোর্টে মুসলিম লেখা থাকলেও সে তা নয় প্রকৃত পক্ষে।
এই সত্য অনুধাবন করার পর আমি কোরান পড়তে শুরু করি, ৬-৭ মাস অধ্যয়ন করার পর আমার মাথায় অনেক প্রশ্ন হাজির হয়, তখন আমার বয়স ২০।
এইরকম বয়সে আমি কিভাবে মুসলমান হলাম, সে এক অদ্ভুত হাস্যকর কাহিনী।
একদিন রাতে আমার কয়েকজন অস্ট্রলিয়ান বন্ধু বড় অক্ষরে ছাপানো এক খন্ড কোরানুল করিম দিলো। আমার কাছে ছোট অক্ষরের কোরান আগেও ছিলো। সেদিন রাতে কেন জানি আমি বিছানায় বসলাম সেই কোরান খন্ড হাতে নিয়ে। পাশে জ্বালালাম একটি মোমবাতি। জানালা খুলে দিলাম। গ্রীষ্ম কালের একটি সুন্দর সোনালী সন্ধ্যা। আবহাওয়া চমৎকার, চারিদিক নির্জন। একটা পবিত্র অনুভুতি অনুভব করছিলাম, অতি সুন্দর।
কোরান পড়া শুরু করলাম অন্যান্য রাতের মতো আর ভাবনা গুলো খেলতে শুরু করলো মাথার ভেতরে। মনে হলো বইটিতে ঠিক সেই কথাগুলিই লেখা আছে যা একজন সৃষ্টি কর্তার তরফ থেকে হওয়া উচিত। আবার এক ধরনের দ্বন্দও কাজ করছিলো, কি জানি হয়ত ঈশ্বরই নেই, আমি ঠিক বোঝাতে পারবোনা, আমার কারো সহায়তা দরকার ছিল তখন ধাতস্ত হতে, আমি কোরান হাতে ধরে সোজা হয়ে বসলাম।
বললাম ও ঈশ্বর, তুমি যদি থেকেই থাকো আমাকে একটা চিহ্ন দেখাওতো, ভালো বা বড় কিছু। যেমন ধরো এই গরমে এখানে বজ্রপাত হয়না, এখন তুমি যদি আকাশ ফাটিয়ে প্রচন্ড শব্দে একটা ফেলে দাও, আমি বুঝব তুমি আছ। অথবা নিঃশ্বব্দে একটা বিদ্যুৎ চমক দেখাও আকাশের দিগন্তে আলোক ছটা নিয়ে, যদি তুমি এরকম শোনাও বা দেখাও-আমি তোমার, তোমারই গোলাম হয়ে যাবো, কথা দিলাম ।
আকাশে তারা ছাড়া আর কোনো আলো নেই, বজ্রপাত তো দুরের কথা জেট বিমানেরও কোনো শব্দও এলোনা।
ঠিক আছে অসময়ে বজ্রপাতের জন্যে হয়তো তুমি রাজি নও ঈশ্বর, তাহলে মটমট করে একটা ডাল বা কোনো কিছু ভাঙ্গার শব্দ শোনাওনা। কিছু কানে এলোনা।
ঠিক আছে ঈশ্বর, আমার সামনে যে মোমবাতিটি জ্বলছে তার শিখাতে একটা বিস্ফোরণ ঘটাও দুই ফুট উচু সিনেমায় যেমন দেখায়, আমি মুগ্ধ হয়ে তোমাকে বিশ্বাস করবো। মোমবাতি মিটমিট করেই জ্বলতে রইলো।
আমি অপেক্ষায় অথচ কিছু ঘটছেনা একটু হতাশা আর গোস্বা অনুভব করলাম। বললাম ঈশ্বর, তুমি নিজেকে সবচেয়ে শক্তিশালী দাবি করো অথচ আমাকে তোমার কোনো চিহ্ন দেখাতে পারলে না! ঠিক আছে আমি তোমাকে আর একটা সুযোগ দিচ্ছি, বজ্রপাতটি একটু বেশি চাওয়া হয়ে গেছে, সব সময় যা হয় সেরকম কিছু করাও, একটা গাড়ীকে লম্বা হর্ন দিয়ে রাস্তা দিয়ে পার করাও, আমি এত ছোট কিছু চাইছি তোমাকে বিশ্বাস করার জন্যে। ধরে নেবো এটাই আমার জন্যে তুমি আছ তার চিহ্ন ঠিক আছে ?
অবাক কান্ড, ঈশ্বর একটা ট্যাক্সিও খুজে পেলেন না যেটা হর্ন দেয় ! মনটা খারাপ হলো, চুপ মেরে আছি। মনে হলো আমি মহাশুন্যের নিস্তবদ্ধতায় বসে আছি, একটি পিপড়ার পদশব্দও শুনছি না, আমি একটু ভেঙ্গেই পড়লাম, ভেবেছিলাম আজকের এই মুহুর্তটিতে আমি কিছু একটা খুঁজে পাবো, যা ঈশ্বর থাকার নিদর্শন। না কিছু হলনা।
হতাশ হয়ে অলস ভঙ্গীতে কোরান হাতে উঠিয়ে পৃষ্ঠা উল্টাতেই চোখ আটকে গেলো একটি আয়াতের দিকে, “বিশ্বাসীদের জন্যে আকাশ ও পৃথিবীতে নিদর্শন রয়েছে। তোমাদের সৃষ্টিতে আর চারদিকে ছড়িয়ে রাখা জীব-জন্তুর সৃজনের মধ্যেও নিদর্শনাবলী রয়েছে। দিন ও রাতের পরিবর্তনে আর বৃষ্টির পরে পৃথিবীকে তার মৃত্যুর পর আবার জীবিত করা হয়, তার মধ্যে আর বায়ুর পরিবর্তনে, এসবই তো নিদর্শন’। (৪৫:৩-৫)
হটাৎ মর্মে অনুধাবন হলো ছোট বেলা বাবা বলেছিলেন, এমনি এমনি হয় প্রাকৃতিক নিয়মগুলি, আমার বোঝা হয়ে গেল এমনি এমনি কিছু হয়না তাতে একজন ডিজাইনার লাগে, তিনি আমাকে তার উপস্থিতি জানিয়েছেন। আমি মুসলিম হবো।
পরদিন সন্ধ্যায় রমজানের প্রথম রাতে আমি যখন মসজিদে অপেক্ষা করছিলাম, আর অসংখ্য মুসলমান তারাবী নামাজ পড়ছিল তখনও এক ধরনের ভয় কাজ করছিলো মনের ভেতর, কিন্তু যখন শেখ ফাহমী আমাকে সত্যই শাহাদা পড়াচ্ছিলেন, কোথায় চলে গেলো সব দ্বিধা, মনে হলো কাদেরকে ভাবতাম এতোদিন জঙ্গী সন্ত্রাসী। মনে হচ্ছিলো আমি একা কোথাও দাঁড়িয়ে, মাথার ওপর গড়িয়ে পড়ছে ঠান্ডা জল, অদ্ভূত এক পবিত্র স্নানে নির্মল হয়ে উঠছে আমরা সর্বাঙ্গ, তনু-মন। সব ভায়েরা আমাকে আলিঙ্গন করে যাচ্ছে মায়া আর ভালবাসার স্পর্শ নিয়ে। আমি প্রস্ফুটিত হয়ে উঠছি।
১৯৯৬ সনে রুবেন মাত্র ২০ বছর বয়সে আবু বকর নাম ধারণ করেন আর বলেন, পশ্চিমারা ধর্মান্তরিত হলে বলে কনভার্ট, মানুষ যখন ইসলাম ধর্মে ঢোকে সে কনভার্ট নয় সে হয় রিভার্ট, যিনি ফিরে আসেন। মুসলিম কোনো নাম নয়, মুসলিম একটি ক্রিয়াপদ, ভার্ব। আমার বাসার পেছনে যে বড় গাছটি আছে সে আল্লাহর হুকুম পালন করছে, আল্লাহ তাকে যা নির্দেশ দিয়েছেন তাই মেনে চলছে। গাছটি আমার কাছে মুসলিম। সে আল্লাহর ইচ্ছার কাছে নিজেকে সঁপে দিচ্ছে।
যখন একটি বাচ্চার জন্ম হয় তখন ক্ষুধা লাগলে কাঁদে, সব বাচ্চারাই কাঁদে, এই প্রাকৃতিক নিয়ম সে আল্লাহর ডিজাইনে করে। সে তখন মুসলিম। যখন সে বড় হয় তখন সে অন্যদের কাছ থেকে নতুন কিছু শিখে এবং অন্যের আদর্শকে অনুসরণ করে মুসলিম থেকে সরে যায়। পরবর্তী সময়ে সে যদি ফিরে আসতে চায় সে রিভার্ট করছে নিজেকে, কনভার্ট নয়। কারণ আল্লাহ বলেছেন, আমি সব শিশুকে মুসলিম হিসেবে জন্ম দেই।
আমি ফিরে এসেছি মানুষের জন্যে এক অফুরন্তজীবনের উৎসে, আমি একজন মুসলিম, বাকিরাও তাই ছিলো, তারাও আসবে একদিন ফিরে ।
‘হে মানুষ, আমি তোমাদের এক পুরুষ আর এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি, পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পারো। তোমাদের মধ্যে সে-ই আল্লাহর কাছে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন যে বেশি সাবধানী। আল্লাহ সব কিছু জানেন, সব খবর রাখেন।’ (৪৯:১৩ )
– লিখেছেন আবু বকর
(তিনি একজন মনস্তত্ববিদ এবং একজন ফিল্ম-মেকার। প্রেস্টন ভিক্টোরিয়াতে তার নিবাস – “আমাদের সময়” পত্রিকায় তার এ লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে )
ফেরা -
"যখন আমার স্ত্রী আমাদের প্রথম সন্তানের জন্ম দেয়,তখন আমার বয়স ৩০ এর বেশি নয়।সেই রাতটির কথা আজও আমার মনে আছে।
প্রতিদিনকার অভ্যাসমত, ঐ রাতটির পুরো সময় আমি বাইরেই কাটিয়েছি আমার বন্ধুদের নিয়ে।পুরো রাত কাটে গল্পে,আড্ডায় এবং লোকজনকে উপহাস করে।আমি ছিলাম তেমনই একজন, যারা মানুষকে হাসাতে পারতো।আমি অন্যদের নিয়ে উপহাস করতাম, ঠাট্টা করতাম,আর আমার বন্ধুরা এসব দেখে শুধুই হাসতো।
সেই রাতে আমি বুঝতে পারলাম, আমি তাদেরকে প্রচুর হাসাতে পারি।মানুষকে নকল করার অসাধারন এক ক্ষমতা আমার ছিলো।কারো স্বর নকল করে তাকে উত্যক্ত করতে পারতাম।
আমার এই ঠাট্টা - মশকারি থেকে কেউই রেহাই পাচ্ছিলোনা, এমনকি আমার বন্ধুরাও না।
আমার এসব ঠাট্টা থেকে বাঁচার জন্য তাদের কেউ কেউ আমাকে তখন এড়িয়ে চলছিল।
আমি এখনও মনে করতে পারি, সে রাতে আমি একজন অন্ধ ভিক্ষুককে নিয়ে ঠাট্টা করেছিলাম যে মার্কেটের রাস্তার ধারে ভিক্ষা করছিলো।সেটা ছিল খুব শোচনীয়! সে যখন অন্ধকারে আসছিলো, আমি তখন তার সামনে আমার পা বসিয়ে দিলাম।সে ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেলো এবং চারদিকে মাথা ঘুরিয়ে দেখছিলো কে তাকে ল্যাঙ মেরে মাটিতে ফেলে দিলো।কিন্ত সে কিছুই বলতে পারছিলো না।
.
আমি বাড়িতে ফিরলাম, যেরকম দেরি করে প্রত্যেকদিনই ফিরি, এবং দেখলাম আমার স্ত্রী আমার জন্য তখনও অপেক্ষা করছিলো।
তার অবস্থা ছিলো ভয়ানক রকম খারাপ।সে কম্পিত গলায় জিজ্ঞেস করলো,- 'রাশেদ, তুমি এতক্ষন কোথায় ছিলে?'
- 'কোথায় থাকবো? মঙ্গলগ্রহে?' - আমি ব্যাঙ্গাত্মকভাবে উত্তর দিলাম - 'অবশ্যই বন্ধুদের সাথে ছিলাম।'
তাকে ক্লান্ত লাগছিলো।সে কান্না চাপা স্বরে বললো,- 'রাশেদ, আমি খুবই ক্লান্ত।আমার মনে হয় একটু পরেই আমাদের সন্তান পৃথিবীতে আসতে যাচ্ছে।'
এইটুকু বলতেই এক ফোঁটা অশ্রু তার চোখ বেয়ে বুকে গড়িয়ে পড়ল।
আমি তখন বুঝতে পারলাম, আমি তাকে অবহেলা করছি।আমার উচিত ছিল তার যত্ন নেওয়া, অন্তত সে যতদিন গর্ভবতী আছে,ততদিন।
এই দিনগুলো বাইরে নষ্ট করা আমার একদম ঠিক হয়নি। দ্রুত তাকে আমি হাসপাতালে নিয়ে গেলাম।তাকে ডেলিভারি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো।সে তখন ভয়ানক প্রসব বেদনার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলো।
আমি উদ্বিগ্নতা নিয়ে আমাদের সন্তান জন্ম নেওয়ার অপেক্ষা করছিলাম।কিন্ত আমার স্ত্রীর ডেলিভারিটা কঠিন ছিল।
আমি ততক্ষন পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলাম যতক্ষন না ক্লান্ত হচ্ছি।হাসপাতালে আমার স্ত্রীর সেবায় কর্তব্যরত নার্স মহিলাকে আমার ফোন নাম্বার দিয়ে আমি বাসায় চলে এলাম,যাতে তারা আমাকে ফোনে সুসংবাদটা দিতে পারে।এক ঘণ্টা পরে, তারা ফোন দিয়ে আমাকে আমার পুত্র সালেমের জন্মের অভিবাদন জানালো।আমি তাড়াতাড়ি করে হাসপাতালে চলে এলাম।যখনই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাকে দেখলো, তারা আমাকে আমার স্ত্রীর ডেলিভারিতে কর্তব্যরত চিকিৎসকের সাথে দেখা করতে বললো।
আমি চিৎকার করে বললাম,- 'কিসের ডাক্তার? আমি এক্ষুনি আমার ছেলেকে দেখতে চাই।'
তারা বললো,- 'প্লিজ, আগে ডাক্তারের সাথে দেখা করুন।'
আমি ডাক্তারের কাছে গেলাম।তিনি আমাকে আমার স্ত্রীর ভয়াবহ ডেলিভারির কথা বললেন।
এবং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হতে বললেন।
.
তারপর তিনি বললেন,- 'আপনার সন্তানের চোখে সমস্যা আছে।সম্ভবত সে কখনোই চোখে দেখবেনা।'
আমি কোনরকমে কান্না চেপে ধরে মাথা নিচু করে ফেললাম। আমার মনে পড়লো সেই অন্ধ ভিক্ষুকের কথা, যাকে মার্কেটে আমি ল্যাঙ মেরে ফেলে দিয়েছিলাম অন্যদের হাসানোর জন্য।
সুবাহান-আল্লাহ! আপনি তাই পাবেন,যা আপনি দেবেন।
তখন আমি কি বলবো তাই ভেবে পাচ্ছিলাম না।হঠাৎ আমার স্ত্রী আর সদ্যজাত সন্তানের কথা মনে পড়ল। ডাক্তারকে তার দয়ার জন্য ধন্যবাদ দিয়ে আমি আমার স্ত্রী আর সন্তানকে দেখতে গেলাম।
আমার স্ত্রীকে আমি মোটেই বিষন্ন দেখলাম না।আল্লাহর উপর তার বিশ্বাস ছিলো।সে ছিল সন্তুষ্ট।
সে কতোবারই না আমাকে বলতো,- 'মানুষকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকারি করো না।'
সে আমাকে বারবার এই কথা বলতো।আমি শুনতাম না।
.
পুত্র সালেমসহ আমরা হাসপাতাল থেকে বাসায় চলে এলাম।
বাস্তবে, আমি সালেমের প্রতি উদাসীন ছিলাম।মনে করতাম, সালেম আমাদের পরিবারেই থাকেনা।সে আমাদের কেউ না,এরকম।
যখন সে জোরে জোরে কান্না করতো, তখন আমি ঘুমানোর জন্য অন্য কক্ষে চলে যেতাম।
কিন্ত আমার স্ত্রী তার খুব যত্ন করতো।তাকে অনেক ভালোবাসতো।
নিজের ক্ষেত্রে, আমি তাকে ঘৃণা করতাম না।কিন্ত এও ঠিক যে, আমি তাকে ভালোও বাসতে পারতাম না।
সালেম আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে।হামাগুড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছে।যখন তার বয়স এক বছর, সে তখন হাঁটার চেষ্টা করছিলো।তখন আমরা লক্ষ্য করলাম, সে আসলে প্রতিবন্ধী।
আমি তখন তাকে আমার উপর বোঝা মনে করলাম।
.
সালেমের পর আমার স্ত্রী আরো দু'টি সন্তানের জন্ম দেয়।উমর এবং খালেদ।
বছর যেতে লাগলো।সালেম বড় হচ্ছিলো।সাথে উমর এবং খালেদও।বাসায় থাকতে আমার ভালো লাগতোনা।আমি আগের মতোই বেশিরভাগ সময় বন্ধুদের সাথে বাইরে বাইরে কাটাতাম।
আমার এরকম আচরনে আমার স্ত্রী কখনোই আশা ছেড়ে দেয়নি।সে সবসময় আমার হিদায়াতের জন্য দো'য়া করতো।আমার এহেন আচরণে সে কখনোই রাগ করতোনা।কিন্ত সে মনে মনে খুব কষ্ট পেতো, যখন সে দেখতো আমি পুত্র সালেমকে অবহেলা করে অন্য দু'জনকে আদর করছি।সালেম বড় হচ্ছিলো আর সাথে বাড়ছিল আমার দুশ্চিন্তাও।
আমার স্ত্রী যখন তাকে একটি ভাল প্রতিবন্ধী স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিতে বললো, আমি আপত্তি জানাইনি।
কতগুলো বছর যে চলে গেলো, আমি বুঝতেই পারলাম না।আমি দিনগুলো ছিল আগের মতই।
খাওয়া-কাজ-আড্ডা-ঘুম। এভাবেই।
এক শুক্রবার। আমি বেলা এগারোটা'য় ঘুম থেকে উঠলাম।বলা চলে,প্রতিদিনের তুলনায় সেদিন আমি অনেক ভোরেই জেগেছি।কারন, আমার এক জায়গায় দাওয়াত ছিলো।আমি কাপড় পরে,গায়ে পারফিউম মেখে বের হতে যাচ্ছিলাম।
যখনই আমি আমাদের বেডরুম অতিক্রম করছিলাম, আমি দেখলাম, সালেম একা একা কাঁদছে।
তার জন্মের পর এই প্রথমবার আমি তাকে নিজ চোখে কাঁদতে দেখছি।দশ বছর কেটে গেলো,কিন্ত এতদিন আমি তার দিকে একটু নজরও দিইনি।এবারও আমি তাকে ইগনোর করতে চেয়েছিলাম,কিন্ত কেন যেন পারলাম না।
আমি শুনলাম, সে কান্না করছে আর তার মা'কে ডাকছে।
আমি এই প্রথমবার তার কাছে গেলাম এবং জিজ্ঞেস করলাম,- 'সালেম, তুমি কাঁদছো কেনো?'
আমার কণ্ঠ শোনামাত্র সে কান্না থামালো।আমাকে তার এত কাছে পেয়ে সে তার ছোট ছোট হাত দুটি হাতড়িয়ে আমাকে অনুভব করার চেষ্টা করতে লাগলো।সে তখনও বুঝতে পারছে না তার সাথে কি হচ্ছে।
আমি খেয়াল করলাম, সে আমার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে।যেন সে ঘৃণাভরে আমাকে বলতে চাচ্ছে,- ''এতদিনে আমাকে তোমার মনে পড়লো? এই দশ বছর কোথায় ছিলে?''
আমি তাকে অনুসরন করলাম।দেখলাম, সে তার রুমের দিকে চলে গেলো।
প্রথমে সে তার কান্নার কারণ আমাকে বলতে চায়নি।আমি তার সাথে শান্তভাবে কথা বলতে লাগলাম।এরপর সে আমাকে তার কান্নার কারন বললো।সে যখন আমাকে তার কান্নার কারন বলছিলো, আমি তা শুনছিলাম আর কাঁপছিলাম।
বলতে পারো কি সেই কারন?
তার ছোট ভাই উমর, যে তাকে ধরে ধরে প্রতিদিন মসজিদে নিয়ে যায়, সে এখনও তাকে নিতে আসেনি।সালেমের ভয় হচ্ছিলো, না জানি আবার মসজিদে যেতে দেরি হয়ে যায় আর সে মসজিদের সামনের কাতারে বসার জায়গা না পায়।
তাই সে উমর আর তার মা'কে চিৎকার করে ডাকছিল।কিন্ত তারা কেউই সাড়া দিচ্ছেনা দেখেই সে কাঁদছিল।
.
আমি সালেমের পায়ের কাছে বসে গেলাম।দেখলাম,তখনও সালেমের চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।
তার পরের কথাগুলো আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না।আমি আমার হাত দিয়ে তার চোখের জল মুছে দিতে দিতে বললাম,- 'এইজন্যেই কি তুমি কাঁদছিলে,সালেম?'
- 'জ্বি' - সে বললো।
আমি আমার বন্ধুদের কথা ভুলে গেলাম,দাওয়াতের কথা ভুলে গেলাম।
আমি বললাম,- 'সালেম, কেঁদোনা।তুমি কি জানো আজ কে তোমাকে মসজিদে নিয়ে যাচ্ছে?'
সালেম বললো,- 'উমরই নিয়ে যাবে।কিন্ত সে সবসময় দেরি করে ফেলে।'
-- 'না সালেম।আজ আমিই তোমাকে মসজিদে নিয়ে যাবো।'- আমি বললাম।
সালেম খুব অবাক হলো।সে কিছুতেই এটা বিশ্বাস করতে পারছিলোনা।সে ভেবেছে, আমি তার সাথে ঠাট্টা করছি।সে আবার কাঁদতে লাগলো।
আমি আমার হাত দিয়ে তার চোখের জল মুছে দিলাম, এবং আমার হাত তার হাতের উপর রাখলাম।আমি তাকে আমার গাড়িতে করে মসজিদে নিয়ে যেতে চাইলাম,কিন্ত সে আপত্তি জানালো।সে বললো,- 'মসজিদ খুব কাছেই।আমাকে ধরে নিয়ে যান।'
.
শেষ কবে যে আমি মসজিদে ঢুকেছিলাম আমার মনে নেই।কিন্ত এতবছর ধরে যা পাপ আমি করেছি,তার জন্যে এই প্রথম আমার মনের ভেতর ভয় এবং অনুতাপ অনুভব করলাম।
পুরো মসজিদ মুসল্লিতে ভরপুর ছিল।কিন্ত তবুও আমি দেখলাম, একদম সামনের কাতারে সালেমের জন্য একটা খালি জায়গা রেখে দেওয়া আছে।আমরা একসাথে জুমার খুতবা শুনলাম।সালেম আমার পরে পরে রুকু-সিজদাতে যাচ্ছিলো, কিন্ত বাস্তবপক্ষে, মনে হচ্ছিলো, আমিই তার পরে পরে রুকু-সিজদা করছি।
নামাজের পর সে আমাকে একটি কুরআন এনে দিতে বললো।আমি অবাক হলাম।সে তো অন্ধ।সে কি করে কুরআন তেলাওয়াত করবে?
আমি তার অনুরোধ প্রায়ই প্রত্যাখ্যান করতে চাইলাম,কিন্ত তখন তার অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে এরকম কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলোনা।আমি তাকে একটি কুরআন এনে দিলাম।সে আমাকে বললো কুরআনের সূরা কাহফ খুলে দিতে।আমি কুরআনের পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগলাম আর সূচিপত্র দেখে সূরা কাহফ খুঁজতে লাগলাম।
সে আমার হাত থেকে কুরআন নিয়ে নিল।সেটি তার সামনে ধরলো আর সূরা কাহফ [কুরআনের ১৮নং সূরা] তিলাওয়াত করতে লাগলো।
ইয়া আল্লাহ! পুরো সূরা কাহফ তার মুখস্ত!!
.
আমি নিজেই নিজের প্রতি লজ্জিত হলাম।আমিও একটি কুরআন হাতে নিলাম।তখন আমার পুরো শরীর কাঁপছিল।আমি কুরআন তিলাওয়াত করেই যাচ্ছি।আমি আল্লাহর কাছে বারবার মাফ চাইছিলাম আর বলছিলাম, - 'হে আল্লাহ! আমাকে সিরাতুল মুস্তাকিমের পথ দেখাও।'
আমি এভাবে আর থাকতে পারলাম না।আমি মুহূর্তেই শিশুর মতো কান্না শুরু করলাম।
সেখানে তখনও কিছু মুসল্লি ছিল যারা সুন্নাত আদায় করছিলো।আমি লজ্জিত হলাম।তাই আমি কোনরকমে আমার কান্না চেপে যেতে চাইলাম।আমার চাপা কান্না দীর্ঘায়িত হলো আর শরীর কাঁপছিলো।আমি তখন খেয়াল করলাম, একটি ছোট্ট হাত আমার মুখমণ্ডল স্পর্শ করছে আর আমার চোখের জল মুছে দিচ্ছে।এটা ছিল আমার পুত্র সালেম।
আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম।বললাম, - 'সালেম, তুমি অন্ধ নও।অন্ধ তো আমি, যে অসৎ সঙ্গীর পাল্লায় পড়েছি যারা আমাকে জাহান্নামের দোরগোড়ায় নিয়ে যাচ্ছে।'
.
আমরা বাড়ি চলে এলাম।ততক্ষনে আমার স্ত্রী সালেমের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো।কিন্ত তার উদ্বিগ্নতা আনন্দাশ্রুতে পরিণত হল, যখন সে জানতে পারলো সালেমের সাথে আমিও জুমা'হ আদায় করেছি।
সেদিন থেকে, আমি আর এক ওয়াক্ত সলাতও ছাড়িনি।আমি আমার খারাপ বন্ধুগুলোকে ত্যাগ করলাম এবং মসজিদে নিয়মিত সলাত আদায় করে এরকম কিছু মানুষকে বন্ধু করে নিলাম।
তাদের সাথে মিশতে মিশতে আমি ঈমানের স্বাদ অনুভব করতে লাগলাম।তাদের কাছ থেকে আমি এমন কিছু শিখছিলাম যা আমাকে এই দুনিয়া নয়,পরের দুনিয়া সম্পর্কে ভাবাতে লাগলো।
আমি কোন ধর্মীয় বক্তৃতা মিস করতাম না।প্রায়ই আমি পুরো কুরআন তিলাওয়াত করে ফেলতাম,অনেক সময় সেটা এক মাসের মধ্যেই।
আমি সবসময় আল্লাহর স্মরণে থাকতাম।ভাবতাম, তিনি অবশ্যই আমার পূর্বের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন।আমি আমার পরিবারের দিকে মন দিলাম।আমার স্ত্রীর চোখে-মুখে সবসময় যে ভয়ের রেখা দেখা যেত,সেটি আর নেই।এক টুকরো হাসি আমার ছেলে সালেমের মুখে লেগেই থাকতো।যে কেউ তার এই হাসি দেখতো, তারা বুঝতে পারতো, সে সম্ভবত দুনিয়ার সবকিছুই অর্জন করে ফেলেছে।আল্লাহর এই বিশেষ রহমতের জন্য আমি তার শুক'রিয়া আদায় করলাম।
.
একদিন আমার ঈমানী বন্ধুরা মানুষকে ঈমানের দাওয়াত দেওয়ার জন্য কিছু দূরে যাওয়ার প্ল্যান করলো।আমি যাবো কি যাবো না, এটা নিয়ে দ্বিধায় ভুগছিলাম।আমি ইস্তিখারা করছিলাম আর আমার স্ত্রীর সাথে এই বিষয়ে পরামর্শ করছিলাম।
আমি ভেবেছিলাম সে আমায় যেতে নিষেধ করবে।কিন্ত হলো তার উল্টোটি।সে এটা শুনে খুবই খুশি হলো,এবং উপরন্তু আমাকে যেতে উৎসাহ দিলো।কারণ, সে ইতিপূর্বে কখনো কোথাও যাওয়ার আগে আমাকে তার সাথে পরামর্শ করতে দেখেনি।
আমি সালেমের কাছে গেলাম,এবং বললাম যে আমাকে কিছু দিনের জন্য দাওয়াতি কাজে বেরোতে হবে।
সে অশ্রুসজল চোখে আমার দিকে তার দুই বাহু প্রসারিত করে দিলো।
আমি প্রায়ই সাড়ে তিন মাসের মত বাইরে ছিলাম।তখন আমি যখনি সুযোগ পেতাম,ফোনে আমার স্ত্রী আর সন্তানদের সাথে কথা বলতাম।
আমি তাদের অনেক মিস করতাম।বিশেষ করে সালেমকে।আমি তার কণ্ঠ শোনার জন্য ব্যাকুল ছিলাম কিন্ত আমি চলে আসার পর সবার সাথে কথা হলেও,শুধু তার সাথে আমার কথা হয়নি।
আমি যখনই বাড়িতে ফোন করতাম,তখন হয় সে স্কুলে থাকতো,নয়তো মসজিদে।যখনই আমি আমার স্ত্রীকে বলতাম যে, সালেমকে আমি কতোটা মিস করছি, তখন সে আনন্দে,গর্বে হাসতো, শুধু শেষবার যখন ফোনে কথা বলি সেবার ছাড়া।তার কণ্ঠস্বর পাল্টে গেল।আমি বললাম,- 'সালেমকে আমার সালাম দিও।'
সে শুধু বললো,- 'ইনশাআল্লাহ! এরপর চুপ করে গেলো।'
.
আমি বাড়ি এলাম।দরজায় নক করলাম।আমি ভেবেছিলাম যে, সালেমই আমার জন্য দরজা খুলে দিবে।কিন্ত আমাকে অবাক করে দিয়ে খালেদই দরজা খুলে দিলো যার বয়স চার বছরের বেশি ছিল না।
সে যখন আমাকে 'বাবা বাবা' বলে ডাকছিল,তখন আমি তাকে কোলে তুলে নিলাম।কেন জানিনা, যখন থেকে ঘরে ঢুকলাম,তখন থেকেই আমার মনের ভেতর একটা ভয় কাজ করছিলো।
আমি শয়তানের প্ররোচনা থেকে আল্লাহর পানাহ চাইলাম।আমি আমার স্ত্রীর কাছে গেলাম।তার চেহারা ছিলো ভিন্ন।যেন সে ভাল থাকার অভিনয় করছে এরকম।
.
আমি তাকে বললাম,- 'কি হয়েছে তোমার?'
- 'কিছু না।'- সে জবাব দিলো।
হঠাৎ, আমার সালেমের কথা মনে পড়লো।আমি বললাম,- 'সালেম কোথায়?'
সে কিছুই বললনা।মাথা নিচু করে ফেললো।তার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
আমি কান্না শুরু করলাম।চিৎকার করে বললাম,- 'সালেম, কোথায় সালেম?'
তখন দেখলাম, আমার চার বছরের ছেলে খালেদ তার মতো করেই বলছে, - 'বাববা! তালেম দান্নাতে তলে গেথে আল্লাহর তাতে!'
আমার স্ত্রী এটা সহ্য করতে পারল না।সে ফ্লোরে পড়ে গেলো আর দ্রুত রুম ছেড়ে চলে গেলো।
পরে আমি জানতে পারলাম, আমি যাওয়ার দুই সপ্তাহ পরে সালেম জ্বরে আক্রান্ত হয়।আমার স্ত্রী তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।কিন্ত সে আর সেরে ওঠেনি।জ্বরের উসিলায় সে আল্লাহর সাক্ষাৎে চলে গেলো।"
.
[[ একটি ইংরেজি ম্যাগাজিন পেপার থেকে সংগৃহিত, রাশেদ নামের এক বাবার হিদায়াতের বাস্তব গল্প। অসাধারণ এই লেখাটি অনুবাদ করেছেন ভাই #আরিফ_আজাদ ]]
সেই রাতে আমি বুঝতে পারলাম, আমি তাদেরকে প্রচুর হাসাতে পারি।মানুষকে নকল করার অসাধারন এক ক্ষমতা আমার ছিলো।কারো স্বর নকল করে তাকে উত্যক্ত করতে পারতাম।
আমার এই ঠাট্টা - মশকারি থেকে কেউই রেহাই পাচ্ছিলোনা, এমনকি আমার বন্ধুরাও না।
আমার এসব ঠাট্টা থেকে বাঁচার জন্য তাদের কেউ কেউ আমাকে তখন এড়িয়ে চলছিল।
আমি এখনও মনে করতে পারি, সে রাতে আমি একজন অন্ধ ভিক্ষুককে নিয়ে ঠাট্টা করেছিলাম যে মার্কেটের রাস্তার ধারে ভিক্ষা করছিলো।সেটা ছিল খুব শোচনীয়! সে যখন অন্ধকারে আসছিলো, আমি তখন তার সামনে আমার পা বসিয়ে দিলাম।সে ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেলো এবং চারদিকে মাথা ঘুরিয়ে দেখছিলো কে তাকে ল্যাঙ মেরে মাটিতে ফেলে দিলো।কিন্ত সে কিছুই বলতে পারছিলো না।
.
আমি বাড়িতে ফিরলাম, যেরকম দেরি করে প্রত্যেকদিনই ফিরি, এবং দেখলাম আমার স্ত্রী আমার জন্য তখনও অপেক্ষা করছিলো।
তার অবস্থা ছিলো ভয়ানক রকম খারাপ।সে কম্পিত গলায় জিজ্ঞেস করলো,- 'রাশেদ, তুমি এতক্ষন কোথায় ছিলে?'
- 'কোথায় থাকবো? মঙ্গলগ্রহে?' - আমি ব্যাঙ্গাত্মকভাবে উত্তর দিলাম - 'অবশ্যই বন্ধুদের সাথে ছিলাম।'
তাকে ক্লান্ত লাগছিলো।সে কান্না চাপা স্বরে বললো,- 'রাশেদ, আমি খুবই ক্লান্ত।আমার মনে হয় একটু পরেই আমাদের সন্তান পৃথিবীতে আসতে যাচ্ছে।'
এইটুকু বলতেই এক ফোঁটা অশ্রু তার চোখ বেয়ে বুকে গড়িয়ে পড়ল।
আমি তখন বুঝতে পারলাম, আমি তাকে অবহেলা করছি।আমার উচিত ছিল তার যত্ন নেওয়া, অন্তত সে যতদিন গর্ভবতী আছে,ততদিন।
এই দিনগুলো বাইরে নষ্ট করা আমার একদম ঠিক হয়নি। দ্রুত তাকে আমি হাসপাতালে নিয়ে গেলাম।তাকে ডেলিভারি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো।সে তখন ভয়ানক প্রসব বেদনার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলো।
আমি উদ্বিগ্নতা নিয়ে আমাদের সন্তান জন্ম নেওয়ার অপেক্ষা করছিলাম।কিন্ত আমার স্ত্রীর ডেলিভারিটা কঠিন ছিল।
আমি ততক্ষন পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলাম যতক্ষন না ক্লান্ত হচ্ছি।হাসপাতালে আমার স্ত্রীর সেবায় কর্তব্যরত নার্স মহিলাকে আমার ফোন নাম্বার দিয়ে আমি বাসায় চলে এলাম,যাতে তারা আমাকে ফোনে সুসংবাদটা দিতে পারে।এক ঘণ্টা পরে, তারা ফোন দিয়ে আমাকে আমার পুত্র সালেমের জন্মের অভিবাদন জানালো।আমি তাড়াতাড়ি করে হাসপাতালে চলে এলাম।যখনই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাকে দেখলো, তারা আমাকে আমার স্ত্রীর ডেলিভারিতে কর্তব্যরত চিকিৎসকের সাথে দেখা করতে বললো।
আমি চিৎকার করে বললাম,- 'কিসের ডাক্তার? আমি এক্ষুনি আমার ছেলেকে দেখতে চাই।'
তারা বললো,- 'প্লিজ, আগে ডাক্তারের সাথে দেখা করুন।'
আমি ডাক্তারের কাছে গেলাম।তিনি আমাকে আমার স্ত্রীর ভয়াবহ ডেলিভারির কথা বললেন।
এবং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হতে বললেন।
.
তারপর তিনি বললেন,- 'আপনার সন্তানের চোখে সমস্যা আছে।সম্ভবত সে কখনোই চোখে দেখবেনা।'
আমি কোনরকমে কান্না চেপে ধরে মাথা নিচু করে ফেললাম। আমার মনে পড়লো সেই অন্ধ ভিক্ষুকের কথা, যাকে মার্কেটে আমি ল্যাঙ মেরে ফেলে দিয়েছিলাম অন্যদের হাসানোর জন্য।
সুবাহান-আল্লাহ! আপনি তাই পাবেন,যা আপনি দেবেন।
তখন আমি কি বলবো তাই ভেবে পাচ্ছিলাম না।হঠাৎ আমার স্ত্রী আর সদ্যজাত সন্তানের কথা মনে পড়ল। ডাক্তারকে তার দয়ার জন্য ধন্যবাদ দিয়ে আমি আমার স্ত্রী আর সন্তানকে দেখতে গেলাম।
আমার স্ত্রীকে আমি মোটেই বিষন্ন দেখলাম না।আল্লাহর উপর তার বিশ্বাস ছিলো।সে ছিল সন্তুষ্ট।
সে কতোবারই না আমাকে বলতো,- 'মানুষকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকারি করো না।'
সে আমাকে বারবার এই কথা বলতো।আমি শুনতাম না।
.
পুত্র সালেমসহ আমরা হাসপাতাল থেকে বাসায় চলে এলাম।
বাস্তবে, আমি সালেমের প্রতি উদাসীন ছিলাম।মনে করতাম, সালেম আমাদের পরিবারেই থাকেনা।সে আমাদের কেউ না,এরকম।
যখন সে জোরে জোরে কান্না করতো, তখন আমি ঘুমানোর জন্য অন্য কক্ষে চলে যেতাম।
কিন্ত আমার স্ত্রী তার খুব যত্ন করতো।তাকে অনেক ভালোবাসতো।
নিজের ক্ষেত্রে, আমি তাকে ঘৃণা করতাম না।কিন্ত এও ঠিক যে, আমি তাকে ভালোও বাসতে পারতাম না।
সালেম আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে।হামাগুড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছে।যখন তার বয়স এক বছর, সে তখন হাঁটার চেষ্টা করছিলো।তখন আমরা লক্ষ্য করলাম, সে আসলে প্রতিবন্ধী।
আমি তখন তাকে আমার উপর বোঝা মনে করলাম।
.
সালেমের পর আমার স্ত্রী আরো দু'টি সন্তানের জন্ম দেয়।উমর এবং খালেদ।
বছর যেতে লাগলো।সালেম বড় হচ্ছিলো।সাথে উমর এবং খালেদও।বাসায় থাকতে আমার ভালো লাগতোনা।আমি আগের মতোই বেশিরভাগ সময় বন্ধুদের সাথে বাইরে বাইরে কাটাতাম।
আমার এরকম আচরনে আমার স্ত্রী কখনোই আশা ছেড়ে দেয়নি।সে সবসময় আমার হিদায়াতের জন্য দো'য়া করতো।আমার এহেন আচরণে সে কখনোই রাগ করতোনা।কিন্ত সে মনে মনে খুব কষ্ট পেতো, যখন সে দেখতো আমি পুত্র সালেমকে অবহেলা করে অন্য দু'জনকে আদর করছি।সালেম বড় হচ্ছিলো আর সাথে বাড়ছিল আমার দুশ্চিন্তাও।
আমার স্ত্রী যখন তাকে একটি ভাল প্রতিবন্ধী স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিতে বললো, আমি আপত্তি জানাইনি।
কতগুলো বছর যে চলে গেলো, আমি বুঝতেই পারলাম না।আমি দিনগুলো ছিল আগের মতই।
খাওয়া-কাজ-আড্ডা-ঘুম। এভাবেই।
এক শুক্রবার। আমি বেলা এগারোটা'য় ঘুম থেকে উঠলাম।বলা চলে,প্রতিদিনের তুলনায় সেদিন আমি অনেক ভোরেই জেগেছি।কারন, আমার এক জায়গায় দাওয়াত ছিলো।আমি কাপড় পরে,গায়ে পারফিউম মেখে বের হতে যাচ্ছিলাম।
যখনই আমি আমাদের বেডরুম অতিক্রম করছিলাম, আমি দেখলাম, সালেম একা একা কাঁদছে।
তার জন্মের পর এই প্রথমবার আমি তাকে নিজ চোখে কাঁদতে দেখছি।দশ বছর কেটে গেলো,কিন্ত এতদিন আমি তার দিকে একটু নজরও দিইনি।এবারও আমি তাকে ইগনোর করতে চেয়েছিলাম,কিন্ত কেন যেন পারলাম না।
আমি শুনলাম, সে কান্না করছে আর তার মা'কে ডাকছে।
আমি এই প্রথমবার তার কাছে গেলাম এবং জিজ্ঞেস করলাম,- 'সালেম, তুমি কাঁদছো কেনো?'
আমার কণ্ঠ শোনামাত্র সে কান্না থামালো।আমাকে তার এত কাছে পেয়ে সে তার ছোট ছোট হাত দুটি হাতড়িয়ে আমাকে অনুভব করার চেষ্টা করতে লাগলো।সে তখনও বুঝতে পারছে না তার সাথে কি হচ্ছে।
আমি খেয়াল করলাম, সে আমার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে।যেন সে ঘৃণাভরে আমাকে বলতে চাচ্ছে,- ''এতদিনে আমাকে তোমার মনে পড়লো? এই দশ বছর কোথায় ছিলে?''
আমি তাকে অনুসরন করলাম।দেখলাম, সে তার রুমের দিকে চলে গেলো।
প্রথমে সে তার কান্নার কারণ আমাকে বলতে চায়নি।আমি তার সাথে শান্তভাবে কথা বলতে লাগলাম।এরপর সে আমাকে তার কান্নার কারন বললো।সে যখন আমাকে তার কান্নার কারন বলছিলো, আমি তা শুনছিলাম আর কাঁপছিলাম।
বলতে পারো কি সেই কারন?
তার ছোট ভাই উমর, যে তাকে ধরে ধরে প্রতিদিন মসজিদে নিয়ে যায়, সে এখনও তাকে নিতে আসেনি।সালেমের ভয় হচ্ছিলো, না জানি আবার মসজিদে যেতে দেরি হয়ে যায় আর সে মসজিদের সামনের কাতারে বসার জায়গা না পায়।
তাই সে উমর আর তার মা'কে চিৎকার করে ডাকছিল।কিন্ত তারা কেউই সাড়া দিচ্ছেনা দেখেই সে কাঁদছিল।
.
আমি সালেমের পায়ের কাছে বসে গেলাম।দেখলাম,তখনও সালেমের চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।
তার পরের কথাগুলো আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না।আমি আমার হাত দিয়ে তার চোখের জল মুছে দিতে দিতে বললাম,- 'এইজন্যেই কি তুমি কাঁদছিলে,সালেম?'
- 'জ্বি' - সে বললো।
আমি আমার বন্ধুদের কথা ভুলে গেলাম,দাওয়াতের কথা ভুলে গেলাম।
আমি বললাম,- 'সালেম, কেঁদোনা।তুমি কি জানো আজ কে তোমাকে মসজিদে নিয়ে যাচ্ছে?'
সালেম বললো,- 'উমরই নিয়ে যাবে।কিন্ত সে সবসময় দেরি করে ফেলে।'
-- 'না সালেম।আজ আমিই তোমাকে মসজিদে নিয়ে যাবো।'- আমি বললাম।
সালেম খুব অবাক হলো।সে কিছুতেই এটা বিশ্বাস করতে পারছিলোনা।সে ভেবেছে, আমি তার সাথে ঠাট্টা করছি।সে আবার কাঁদতে লাগলো।
আমি আমার হাত দিয়ে তার চোখের জল মুছে দিলাম, এবং আমার হাত তার হাতের উপর রাখলাম।আমি তাকে আমার গাড়িতে করে মসজিদে নিয়ে যেতে চাইলাম,কিন্ত সে আপত্তি জানালো।সে বললো,- 'মসজিদ খুব কাছেই।আমাকে ধরে নিয়ে যান।'
.
শেষ কবে যে আমি মসজিদে ঢুকেছিলাম আমার মনে নেই।কিন্ত এতবছর ধরে যা পাপ আমি করেছি,তার জন্যে এই প্রথম আমার মনের ভেতর ভয় এবং অনুতাপ অনুভব করলাম।
পুরো মসজিদ মুসল্লিতে ভরপুর ছিল।কিন্ত তবুও আমি দেখলাম, একদম সামনের কাতারে সালেমের জন্য একটা খালি জায়গা রেখে দেওয়া আছে।আমরা একসাথে জুমার খুতবা শুনলাম।সালেম আমার পরে পরে রুকু-সিজদাতে যাচ্ছিলো, কিন্ত বাস্তবপক্ষে, মনে হচ্ছিলো, আমিই তার পরে পরে রুকু-সিজদা করছি।
নামাজের পর সে আমাকে একটি কুরআন এনে দিতে বললো।আমি অবাক হলাম।সে তো অন্ধ।সে কি করে কুরআন তেলাওয়াত করবে?
আমি তার অনুরোধ প্রায়ই প্রত্যাখ্যান করতে চাইলাম,কিন্ত তখন তার অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে এরকম কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলোনা।আমি তাকে একটি কুরআন এনে দিলাম।সে আমাকে বললো কুরআনের সূরা কাহফ খুলে দিতে।আমি কুরআনের পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগলাম আর সূচিপত্র দেখে সূরা কাহফ খুঁজতে লাগলাম।
সে আমার হাত থেকে কুরআন নিয়ে নিল।সেটি তার সামনে ধরলো আর সূরা কাহফ [কুরআনের ১৮নং সূরা] তিলাওয়াত করতে লাগলো।
ইয়া আল্লাহ! পুরো সূরা কাহফ তার মুখস্ত!!
.
আমি নিজেই নিজের প্রতি লজ্জিত হলাম।আমিও একটি কুরআন হাতে নিলাম।তখন আমার পুরো শরীর কাঁপছিল।আমি কুরআন তিলাওয়াত করেই যাচ্ছি।আমি আল্লাহর কাছে বারবার মাফ চাইছিলাম আর বলছিলাম, - 'হে আল্লাহ! আমাকে সিরাতুল মুস্তাকিমের পথ দেখাও।'
আমি এভাবে আর থাকতে পারলাম না।আমি মুহূর্তেই শিশুর মতো কান্না শুরু করলাম।
সেখানে তখনও কিছু মুসল্লি ছিল যারা সুন্নাত আদায় করছিলো।আমি লজ্জিত হলাম।তাই আমি কোনরকমে আমার কান্না চেপে যেতে চাইলাম।আমার চাপা কান্না দীর্ঘায়িত হলো আর শরীর কাঁপছিলো।আমি তখন খেয়াল করলাম, একটি ছোট্ট হাত আমার মুখমণ্ডল স্পর্শ করছে আর আমার চোখের জল মুছে দিচ্ছে।এটা ছিল আমার পুত্র সালেম।
আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম।বললাম, - 'সালেম, তুমি অন্ধ নও।অন্ধ তো আমি, যে অসৎ সঙ্গীর পাল্লায় পড়েছি যারা আমাকে জাহান্নামের দোরগোড়ায় নিয়ে যাচ্ছে।'
.
আমরা বাড়ি চলে এলাম।ততক্ষনে আমার স্ত্রী সালেমের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো।কিন্ত তার উদ্বিগ্নতা আনন্দাশ্রুতে পরিণত হল, যখন সে জানতে পারলো সালেমের সাথে আমিও জুমা'হ আদায় করেছি।
সেদিন থেকে, আমি আর এক ওয়াক্ত সলাতও ছাড়িনি।আমি আমার খারাপ বন্ধুগুলোকে ত্যাগ করলাম এবং মসজিদে নিয়মিত সলাত আদায় করে এরকম কিছু মানুষকে বন্ধু করে নিলাম।
তাদের সাথে মিশতে মিশতে আমি ঈমানের স্বাদ অনুভব করতে লাগলাম।তাদের কাছ থেকে আমি এমন কিছু শিখছিলাম যা আমাকে এই দুনিয়া নয়,পরের দুনিয়া সম্পর্কে ভাবাতে লাগলো।
আমি কোন ধর্মীয় বক্তৃতা মিস করতাম না।প্রায়ই আমি পুরো কুরআন তিলাওয়াত করে ফেলতাম,অনেক সময় সেটা এক মাসের মধ্যেই।
আমি সবসময় আল্লাহর স্মরণে থাকতাম।ভাবতাম, তিনি অবশ্যই আমার পূর্বের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন।আমি আমার পরিবারের দিকে মন দিলাম।আমার স্ত্রীর চোখে-মুখে সবসময় যে ভয়ের রেখা দেখা যেত,সেটি আর নেই।এক টুকরো হাসি আমার ছেলে সালেমের মুখে লেগেই থাকতো।যে কেউ তার এই হাসি দেখতো, তারা বুঝতে পারতো, সে সম্ভবত দুনিয়ার সবকিছুই অর্জন করে ফেলেছে।আল্লাহর এই বিশেষ রহমতের জন্য আমি তার শুক'রিয়া আদায় করলাম।
.
একদিন আমার ঈমানী বন্ধুরা মানুষকে ঈমানের দাওয়াত দেওয়ার জন্য কিছু দূরে যাওয়ার প্ল্যান করলো।আমি যাবো কি যাবো না, এটা নিয়ে দ্বিধায় ভুগছিলাম।আমি ইস্তিখারা করছিলাম আর আমার স্ত্রীর সাথে এই বিষয়ে পরামর্শ করছিলাম।
আমি ভেবেছিলাম সে আমায় যেতে নিষেধ করবে।কিন্ত হলো তার উল্টোটি।সে এটা শুনে খুবই খুশি হলো,এবং উপরন্তু আমাকে যেতে উৎসাহ দিলো।কারণ, সে ইতিপূর্বে কখনো কোথাও যাওয়ার আগে আমাকে তার সাথে পরামর্শ করতে দেখেনি।
আমি সালেমের কাছে গেলাম,এবং বললাম যে আমাকে কিছু দিনের জন্য দাওয়াতি কাজে বেরোতে হবে।
সে অশ্রুসজল চোখে আমার দিকে তার দুই বাহু প্রসারিত করে দিলো।
আমি প্রায়ই সাড়ে তিন মাসের মত বাইরে ছিলাম।তখন আমি যখনি সুযোগ পেতাম,ফোনে আমার স্ত্রী আর সন্তানদের সাথে কথা বলতাম।
আমি তাদের অনেক মিস করতাম।বিশেষ করে সালেমকে।আমি তার কণ্ঠ শোনার জন্য ব্যাকুল ছিলাম কিন্ত আমি চলে আসার পর সবার সাথে কথা হলেও,শুধু তার সাথে আমার কথা হয়নি।
আমি যখনই বাড়িতে ফোন করতাম,তখন হয় সে স্কুলে থাকতো,নয়তো মসজিদে।যখনই আমি আমার স্ত্রীকে বলতাম যে, সালেমকে আমি কতোটা মিস করছি, তখন সে আনন্দে,গর্বে হাসতো, শুধু শেষবার যখন ফোনে কথা বলি সেবার ছাড়া।তার কণ্ঠস্বর পাল্টে গেল।আমি বললাম,- 'সালেমকে আমার সালাম দিও।'
সে শুধু বললো,- 'ইনশাআল্লাহ! এরপর চুপ করে গেলো।'
.
আমি বাড়ি এলাম।দরজায় নক করলাম।আমি ভেবেছিলাম যে, সালেমই আমার জন্য দরজা খুলে দিবে।কিন্ত আমাকে অবাক করে দিয়ে খালেদই দরজা খুলে দিলো যার বয়স চার বছরের বেশি ছিল না।
সে যখন আমাকে 'বাবা বাবা' বলে ডাকছিল,তখন আমি তাকে কোলে তুলে নিলাম।কেন জানিনা, যখন থেকে ঘরে ঢুকলাম,তখন থেকেই আমার মনের ভেতর একটা ভয় কাজ করছিলো।
আমি শয়তানের প্ররোচনা থেকে আল্লাহর পানাহ চাইলাম।আমি আমার স্ত্রীর কাছে গেলাম।তার চেহারা ছিলো ভিন্ন।যেন সে ভাল থাকার অভিনয় করছে এরকম।
.
আমি তাকে বললাম,- 'কি হয়েছে তোমার?'
- 'কিছু না।'- সে জবাব দিলো।
হঠাৎ, আমার সালেমের কথা মনে পড়লো।আমি বললাম,- 'সালেম কোথায়?'
সে কিছুই বললনা।মাথা নিচু করে ফেললো।তার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
আমি কান্না শুরু করলাম।চিৎকার করে বললাম,- 'সালেম, কোথায় সালেম?'
তখন দেখলাম, আমার চার বছরের ছেলে খালেদ তার মতো করেই বলছে, - 'বাববা! তালেম দান্নাতে তলে গেথে আল্লাহর তাতে!'
আমার স্ত্রী এটা সহ্য করতে পারল না।সে ফ্লোরে পড়ে গেলো আর দ্রুত রুম ছেড়ে চলে গেলো।
পরে আমি জানতে পারলাম, আমি যাওয়ার দুই সপ্তাহ পরে সালেম জ্বরে আক্রান্ত হয়।আমার স্ত্রী তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।কিন্ত সে আর সেরে ওঠেনি।জ্বরের উসিলায় সে আল্লাহর সাক্ষাৎে চলে গেলো।"
.
[[ একটি ইংরেজি ম্যাগাজিন পেপার থেকে সংগৃহিত, রাশেদ নামের এক বাবার হিদায়াতের বাস্তব গল্প। অসাধারণ এই লেখাটি অনুবাদ করেছেন ভাই #আরিফ_আজাদ ]]
আকাশের দরোজাটা খোলা!
আকাশের দরোজাটা খোলা!
----------------------------------------
শায়খ আলী তানতাভী’র ভাষায়—
‘প্রিয় পাঠক! এখন আমি তোমাদেরকে একটা গল্প শোনাবো। গল্পটা এক আমেরিকান পরিবারের। সদস্য সংখ্যা— আটজন। বাবা মা ও ছয় সন্তান। বাবা কৃষক। বড়ো কর্মঠ মানুষ তিনি। শরীর স্বাস্থ্যও বেশ সুঠাম সুগঠিত। তার মনোবলও খুব আকাশছোঁয়া। যা করতে চান, তা করেই ফেলেন। আর মা ছিলেন বুদ্ধিমতি গুণবতি এক মহিলা। সাধারণ এক কৃষকের বউ হলেও গুণ-বুদ্ধি ও কৌশলে এবং বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতায় তিনি ছিলেন অনেকের চেয়ে সেরা। তাই ছেলে-মেয়েরা গড়ে উঠছিলো তার পরিকল্পিত তত্ত্বাবধানে। মায়ের কাছ থেকে তারা শিখছিলো— কীভাবে বড় হতে হয়। কীভাবে মানুষ হতে হয়। বিপদ এলে ধৈর্য ধরতে হয়। সব প্রতিকুল পরিস্থিতিকে জয় করে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। এমন বাবা মা’র লালন-প্রতিপালন ও তত্ত্বাবধানের ছায়ায় তাই ছেলেরা বেড়ে উঠলো পূর্ণ হয়ে। বড় হওয়ার আগেই তারা বড় হয়ে গেলো।
সবার ছোট্ট ভাইটি একদিন বাইরে খেলছিলো। বয়স আর কতো হবে, মাত্র তের। এ বয়সের খেলায় একটু দুরন্তপনা থাকেই। এ বালকও মেতে উঠেছিলো তেমন দুরন্তপনায়। একটা শিলাখণ্ড থেকে লাফ দিতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এসে পড়লো নিচে। পায়ে ও হাটুতে চোট লাগলো। প্রচণ্ড ব্যথা পেলো। ব্যথা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো। ওর বয়সী কোনো ছেলেই অমন ব্যথা সহ্য করতে পারতো না। কিন্তু ও সহ্য করলো। কাউকেই কিছু বুঝতে দিলো না। রাত গড়িয়ে সকাল এলো। ওর পাঠশালায় যাওয়ার সময় হলো। এ-ব্যথা নিয়ে পাঠশালায় না যাওয়াটাই স্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু ও গেলো এবং পায়ে হেঁটেই গেলো। এ দিকে ব্যথা বাড়ছিলো, তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিলো। ওর ধৈর্যও বাড়ছিলো। এভাবে দু’দিন কেটে গেলো। পা ফুলে গেলো। ব্যথার তীব্রতায় জায়গাটা নীল হয়ে গেলো। এক কদমও আর চলা সম্ভব হচ্ছিলো না। তখন মা-বাবা জানতে পারলেন এবং রাজ্যের শঙ্কা এসে ছায়া বিস্তার করলো তাদের চোখে-মুখে-অনুভবে। তারা ভীষণ অস্থির হয়ে পড়লেন। তাদের কলিজার পানি শুকিয়ে গেলো। তারা উদ্বেগভরে জানতে চাইলেন— ‘এ অবস্থা কী করে হলো?’ এবার ও সবকিছু জানালো। ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে। তখন তারা দ্রুত তাকে বিছানায় শুইয়ে দিলো এবং ডাক্তার ডাকতে বেরিয়ে গেলো। ডাক্তার এসে সব দেখলো। কিন্তু কোনো সুসংবাদ শোনাতে পারলো না। উল্টো দিলো এক মহা দুঃসংবাদ। বললো :
— চিকিৎসার সময় ফুরিয়ে গেছে! পা কেটে ফেলতে হবে! এবং করতে হবে তা এই মুহূর্তেই, নইলে তাকে বাঁচানো যাবে না। কেননা ওর রক্ত দূষিত হয়ে গেছে!
এ-সব মা-বাবাকে বলা হলো এক পাশে এনে কানে কানে, ছেলের অগোচরে। ডাক্তারের একেকটা কথা গিয়ে বিঁধছিলো বাবা-মা’র অনুভবে কাঁটার মতো! ছেলের পা কেটে ফেলতে হবে? এ কী করে সম্ভব! ও সারা জীবন পা-হারা থাকবে? কেমনে চলবে? তবুও বাস্তবতা মেনে নিতে হলো! ওর জীবনের মায়ায় পা কাটতে তারা রাজি হলেন। কাঁদতে কাঁদতে ছেলেকে গিয়ে বললেন :
— তোমার পা কেটে ফেলতে হবে দ্রুত, নইলে তোমাকে বাঁচানো যাবে না!
কিন্তু ছেলে আরো বেশি অপ্রস্তুত হয়ে গেলো এ কথা শোনে! ও পরিস্কার বলো দিলো— ‘না’! গলা ফাটিয়ে কেঁদে উঠলো! বললো :
— তোমরা আমার পা’টা কেটে ফেলো না! বাবা! তুমি আমাকে বাঁচাও! আমার পা কেটে ফেললে আমি হাটবো কেমন করে! বাবা! আমাকে রক্ষা করো! ডাক্তারকে এক্ষুনি চলে যেতে বলো!
ছেলেটা এক পায়ে ভর দিয়ে বিছানা ছেড়ে পালাতে চাইলো। কিন্তু বাবা ওকে ধরে ফেললেন। বিছানায় জোর করে শুইয়ে দিলেন। তখন ও আরো বেশি ভয় পেয়ে গেলো! ওর আর্তচীৎকার আরো বেড়ে গেলো—
— মা! আমাকে বাঁচাও! মা! আমার পা কাটতে দেবে না!
অশ্র“সিক্ত মা পাশে দাঁড়িয়েছিলেন নিথর হয়ে। কী করবেন তিনি? ছেলের ডাকে সাড়া দেবেন না ডাক্তারের উপদেশ মানবেন? তার হৃদয়টা হাহাকার করে উঠলো। কোন্ দিকে যাবেন তিনি? কিছুই বুঝতে পারছিলেন না! দাঁড়িয়ে রইলেন অশ্র“প্লাবিত দৃষ্টি নিয়ে আর ভেঙে যাওয়া হৃদয়ের সীমাহীন ব্যাকুলতা নিয়ে! হায়! তিনি যদি পারতেন ছেলের জন্যে নিজের জীবনটা বিলিয়ে দিতে!
ছেলেটার কান্না ও চীৎকার থামছেই না। মায়ের দিকে ও অশ্র“-করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আকুলি-বিকুলি করছিলো। পানিতে ডুবে যেতে যেতে মানুষ যেভাবে উদ্ধারকারীর উদ্দেশ্যে হাত পা ছুঁড়তে থাকে, ঠিক সেভাবে!
কিন্তু মায়ের আজ কী হয়ে গেলো? মা যে তার ডাকে সাড়া দিচ্ছেন না! মাও কি আজ পর হয়ে গেলেন, বাবার মতন? পৃথিবীর সবাই কি পর হয়ে গেলো? .......
বাবা’র পর ও মা’র ব্যাপারেও হতাশ হয়ে গেলো। এবার আরেকটা নাম ধরে ও চিৎকার করতে লাগলো। ওর বড় ভাইয়ের নাম! বেশি না, ওর চেয়ে সামান্য বড়। পিঠাপিঠি ভাই। এক সাথেই খেলে ওরা। যেনো সহপাঠি, বন্ধু! ও কি এখন সাড়া দেবে? আসবে কি ওকে বাঁচাতে? ওর পা’টাকে রক্ষা করতে? ইদগার! ইদগার! কোথায় তুমি ভাইয়া? এসো না! তুমিও কি আসবে না? তুমিও সবার মতো পর হয়ে যাবে?
ইদগার শুনলো ভাইয়ের আর্ত আবেদন! সাথে সাথে ঝড় উঠলো ওর ভ্রাতৃহৃদয়ে! ছুটেও এলো ঝড়ের গতিতে! এসে দাঁড়ালো ভাইয়ের কাছে, ওর দরোজার মুখে। তারপর? তারপর একটা কাপড় দিয়ে কোমরটা বাঁধলো! কী বলে যেনো বুকে দম করলো!
তারপর? তারপর ঘোষণা করলো—
— সাবধান! তোমরা এদিকে কেউ আসবে না! ওর পা কাটতে আমি দেবো না! ও এমনিতেই সেরে ওঠবে!!
বাবা কাছে এগিয়ে গেলেন! ইদগারকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, পারলেন না!
মা গেলেন, তিনিও পারলেন না! ইদগার যেনো কোনো ছোট্ট কিশোর নয়— এক বীরপুরুষ! এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে জীবনপণ লড়াইয়ে! একদিকে ওর ‘মাজলুম’ ভাই, অন্যদিকে একদল ‘হৃদয়হীন’ মানুষ! না! ইদগার আজ আপোষ করবে না! যে কোনো মূল্যে ভাইটিকে ‘দুষ্ট-স্পর্শ’ থেকে বাঁচাবে, বাঁচাবেই!
বাবা ইদগারকে কথার জোরে বোঝাতে না পেরে গায়ের জোরে সরিয়ে দিতে চাইলেন। পারলেন না! ইদগার ভাইয়ের জন্যে বাবাকে একদম খাতির করলো না। তাকে এবং ডাক্তারটাকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো!
অবাক লাগছে? না, অবাক হওয়ার কিছু নেই! ইদগার এখন সিংহ! যে কোনো মূল্যে এখন ও রক্ষা করতে চায় ভাইকে, তার পা’কে!
এখন সব মানুষ ওর কাছে পর— ভাইটি ছাড়া!
এখন সব মানুষ ওর দুশমন— ভাইটি ছাড়া!
এমন সঙ্গিন মুহূর্তে বিড়ালও হয়ে যায় বাঘ!
মুরগীর কথাই একটু ভাবো! মুরগীর কোনো বাচ্চার উপর কেউ হামলে পড়লে তখন মুরগীটি কেমন পাখনা ফুলিয়ে হামলাকারীকে তেড়ে যায়— দেখেছো কখনো! কিংবা বিড়ালের কথাই ধরো! বিড়াল যখন জীবনের আশা ছেড়ে দেয়, তখন কেমন করে দাঁত খিচিয়ে আক্রমণকারির উপর হামলে পড়তে উদ্ধত হয়— দেখেছো?! নিশ্চয়ই দেখেছো! মুরগীটি তখন হয়ে যায় একটা শিকারি বাজ আর বিড়ালটা হয়ে যায় একটা হিংস্র নেকড়ে! ইদগারের অবস্থাটাও তাই! এখন সে বীর! এখন দেয়াল টলে যেতে পারে কিন্তু ইদগার টলবে না। বাবা-মা এবং ডাক্তার অবস্থা বেগতিক দেখে চলে গেলেন। ভাবলেন— ধীরে ধীরে ইদগার শান্ত হয়ে আসবে। ক্লান্ত হয়ে, বিরক্ত হয়ে তাদের কথা মানতে বাধ্য হবে। ঘুম ও ক্ষুধার কাছে আত্মসমর্পণ করবে। কিন্তু বেলা গড়ানোর পরই বোঝা গেলো, তারা এক নতুন ইদগারের মুখোমুখি হয়েছে। এই ইদগারের সাথে কোনো কালেই তাদের পরিচয় ছিলো না। ও প্রায় না ঘুমিয়ে এবং না খেয়েই ভাইয়ের পাহারায় অবিচল রইলো। কেউ ওর ধারে কাছেও ভিড়তে পারলো না। ডাক্তার একটু পর পর এসে অবস্থা নিরীক্ষণ করছিলো নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে। ডাক্তার কাছে আসা মাত্রই ইদগারের লাল চোখ আরো লাল হয়ে ওঠে। এই লালের সামনে ডাক্তার টিকতে পারে না। অসহায় ভঙ্গিতে ফিরে যায়। হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফেলে। এদিকে ছেলেটার পা আরো ফুলে গেলো। সাথে সাথে নীলে নীল! ডাক্তার আর পারলো না। পুরোপুরি হাত গুটিয়ে নিলো। অশ্র“ভারে আক্রান্ত বাবা মা’র চোখে চোখ রেখে যাবার আগে শুধু বলে গেলো :
— পারা গেলো না! ছেলেটাকে আর বাঁচানো গেলো না! আমি চলে গেলাম! এখানে থেকে সময় নষ্ট করে লাভ নেই! এখন অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ওর পা কেটেও ওকে এখন আর বাঁচানো যাবে না। ওর সামনে অপেক্ষা করছে মৃত্যু। বেদনাময় নীল মৃত্যু!
ডাক্তার চলে যাওয়ার পর বাড়ির পরিবেশটা আরো ভারি হয়ে উঠলো। ছলোছলো নীরব দৃষ্টির ভাঁজে ভাঁজে ঝরে পড়তে লাগলো নীল বেদনা ও হতাশা! সেখানে নেই এখন কোনো আলো। একটু আগে ডাক্তার আশার ক্ষীণতম আলোটিও নিভিয়ে রেখে গেছে!
কঠিন বিপদের মুহূর্তে মানুষ কী করে?
আসলে মানুষ যখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়ায়, মানুষ যখন জীবনের আশা একেবারেই ছেড়ে দেয়, তখন সে আল্লাহর কাছে ফিরে আসে। মু’মিন হোক কিংবা কাফের। মু’মিন তো তখন ফিরে আসেই, কাফেরও ফিরে আসে। কারণ সব মানুষের হৃদয়েই ঈমান লুকিয়ে আছে। এমনকি কট্টর কাফেরের হৃদয়েও। এ জন্যেই আরবী ভাষায় ‘কাফির’ মানে ‘সাতির’। আর সাতির মানে যে নিজের ভিতরে ঈমানকে লুকিয়ে রাখে। যদিও সে ভাবে— তার ভিতরে ঈমান বলতে কিছু নেই। এ জন্যেই বিপদের কঠিন মুহূর্তে লুকিয়ে থাকা সেই ঈমানটাই জেগে ওঠে। কুফরির আবরণ ছাপিয়ে উদিত হয় ঈমানের সেই আলোটা। তাকে দেখায় সঠিক পথ। নিয়ে যায় আল্লাহর আশ্রয়ে। তাকে বাধ্য করে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করতে।
কুরাইশরা মূর্তিপূজা করতো। হোবল-লাত-উয্যা’র উপাসনা করতো। কিন্তু কখন? যখন থাকতো না বিপদ ও সঙ্কট। মূর্তি দুর্বল, কিছুই করার ক্ষমতা ওরা রাখে না— এ বিশ্বাসই ওদের ভিতরে কাজ করতো। তারপরও পূর্ব পুরুষের দোহাই টেনে টেনে ওরা মূর্তিপূজা করতো। কিন্তু যখন আসতো বিপদ ও সঙ্কট! যখন বইতো ঝড় ও তার তাণ্ডব, তখন কী করতো ওরা?
বাণিজ্যিক ভ্রমণে নৌকায় আরোহন করতে হতো ওদেরকে প্রায়ই। তখন সমুদ্র-ঝড়ে পড়লে কী করতো ওরা? যে ঝড়ে নৌকা নিয়ে ঢেউ খেলা করে ঠিক সেভাবেই, যেভাবে ঘূর্ণিবায়ূ খেলা করে পাখির পালক নিয়ে? সেই সঙ্কটকালে তারা কার কাছে আত্মসমর্পণ করতো? লাত-ওয্যা ও হোবলের কাছে নাকি আল্লাহ্র কাছে? না! তখন লাত-ওয্যা ও হোবলের কোনো মূল্য ছিলো না তাদের কাছে, তারা বরং তখন আশ্রয় নিতো আল্লাহর কাছে। তখন সেই লুক্বায়িত ঈমান জ্বলে উঠতো তাদের হৃদয়ে। পরিত্যক্ত হতো লাত উয্যা ও হোবল মানাত। যতো বড় কাফেরই হোক, নৌকাডুবি হলে এবং অথৈ পানিতে কিছু একটা ধরে বেঁচে থাকার চেষ্টাকালে হৃদয় থেকেই ভেসে আসে এই আর্ত আকুতি— হে আল্লাহ! হে আসমান জমিনের মালিক! আমাকে বাঁচাও!
ফেরাউনের সলীল-সমাধি’র কালো ইতিহাস আমাদেরকে কী বলে? অহঙ্কারী ফেরাউন ডুবে যাওয়ার মুহূর্তে কী বলেছিলো? বলেছিলো কি— ‘আমিই সবচে’ বড় প্রভু’? না বলে নি! বলতে পারে নি! কেননা ফেরাউনের হৃদয়ের গভীরেও ঈমানের বীজ লুকিয়ে ছিলো! মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে তাই তার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিলো—
﴿ آمَنتُ أَنَّهُ لا إِلِـهَ إِلاَّ الَّذِي آمَنَتْ بِهِ بَنُو إِسْرَائِيلَ وَأَنَاْ مِنَ الْمُسْلِمِينَ ﴾
‘আমি ঈমান আনলাম যে নেই কোনো ইলাহ সেই সত্তা ছাড়া, যার প্রতি ঈমান এনেছে বনী ইসরাঈল। আর আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত।’
মনে করো, তুমি মরুভূমিতে সফর করছো। প্রচণ্ড পিপাসায় ছটফট করছো। পান করার মতো এক কাতরা পানিও নেই। মৃত্যু ধেয়ে আসছে চারদিক থেকে তোমার দিকে। তখন তুমি কী করবে? ডেকে ওঠবে না কি আর্তনাদ করে— ‘হে আল্লাহ! হে আল্লাহ!!’ বলে?!
যখন নেমে আসে দুর্ভিক্ষ কিংবা অনাবৃষ্টি। চারদিকে কেবল হাহাকার। ‘নেই নেই’ হাহাকার। নেই পানি, নেই খাবার! তখন কার কাছে মানুষ ফিরে যায়? আল্লাহর কাছেই ফিরে যায়!
তুমুল যুদ্ধের সময় মৃত্যু যখন সামনে এসে হাজির হয়, তখন কার কাছে মানুষ আশ্রয় চায়?
সব চিকিৎসা এবং সকল ডাক্তার যখন ব্যর্থ হয়ে যায়, তখন কার কাছে মানুষ ফিরে যায়?
আল্লাহ্র কাছে! অবশ্যই আল্লাহ্র কাছে!!
তখন আল্লাহদ্রোহী আল্লাহর সাথে দ্রোহ করতে ভুলে যায়!
তখন বস্তুবাদী বস্তুবাদে বিশ্বাস করে না।
নাস্তিকও তখন আস্তিক হয়ে যায়! সবাই সমকণ্ঠে বলে ওঠে—
আল্লাহ! আমার আল্লাহ! আমাকে বাঁচাও! আমাকে উদ্ধার করো! আমাকে এবারের মতো মাফ করে দাও!!
ডাক্তার চলে গেলো!
তারপর কী হলো?
তারপর হতাশার অন্ধকারে সব হারিয়ে গেলো!
অসুস্থ ভাইটি হতাশ! ইদগারও হতাশ! বাবা-মা আরো বেশি হতাশ! ডাক্তার আরো বড় হতাশ!
এই হতাশার অন্ধকারে কোনো আলো দেখা গেলো না! আলোর ছিটে-ফোঁটাও না!
সবাই উপায়হীন! সবাই সম্বলহীন!
সবাই অসহায়! দিকভ্রান্ত!
তখন, হ্যাঁ তখনই সবার হাত উঠে গেলো আকাশের দিকে! এক আল্লাহ্র দিকে! তাঁর কাছেই চাইলো সবাই আরোগ্য! শুধু তাঁর কাছেই! নিরুপায়ের একমাত্র উপায় তো তিনিই! নিরুপায় যখন ‘হে আল্লাহ!’ বলে, তখন আল্লাহ্র বলেন : ‘কী হয়েছে আমার বান্দা! বলো, জলদি বলো! আমি হাজির!’ আল্লাহ তখন নিরুপায়কে ফিরিয়ে দেন না। কাফের কিংবা ফাসেক বলে তাকে রাগ করে দূরে ঠেলে দেন না! যে-ই তাঁর দরোজায় হাজির হয় তাকেই তিনি আশ্রয় দেন! তাঁর দরোজা সবার জন্যে খোলা! চির অবারিত! তবে দুনিয়ার কাফের মুশরিকদেরকে তিনি শুধু দুনিয়াই দেন, আখেরাতের কোনো আবদার তিনি রক্ষা করেন না। কেননা, এরা আখেরাতকে বিশ্বাস করে না!
অশ্রুময় ও হৃদয়োৎসারিত প্রার্থনা শেষে দেখা গেলো যে ফোলা ভাবটা অনেকটাই কমে আসছে! বেদনার নীলচে রঙটাও ধীরে ধীরে দূর হয়ে যাচ্ছে! ব্যথাও আগের চেয়ে অনেক কম এবং কমছেই! দু’দিন শেষে পা’টা একেবারেই ভালো হয়ে গেলো!!
রোগী অবাক!
ইদগার অবাক!
মা-বাবা আরো অবাক!
পরিবারের সবাই অবাক!
আর ডাক্তারের চোখ তো একেবারে ছানাবড়া!
সব শোনে এবং সব দেখে সে কোনো হিসাব মেলাতে পারছিলো না!
বন্ধুরা! কী ভাবছো? এ কি কল্পকাহিনী না বাস্তব সত্য? আগেই বলেছি বাস্তব সত্য! কেমন হয়, যদি বলে দিই গল্পের ‘নায়ক’-এর পরিচয়টা? তিনি হলেন দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের মিত্র বাহিনীর সেনাপতি! সুতরাং বুঝতেই পারছো, জগত জোড়া অনেক ছিলো তার খ্যাতি। তার নাম— অ্যাইজেনহাওয়ার (ঊরংবহযড়বিৎ)। তার আরেকটা বড় পরিচয় আছে। পরবর্তীতে তিনি আমেরিকার (৩৪ নাম্বার) প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত হয়েছিলেন। সুতরাং বলতেই হবে— আল্লাহ সবকিছু পারেন। ওষুধের মাধ্যমে তিনি যেমন সুস্থতা দান করতে পারেন তেমনি বিনা ওষুধ ও বিনা চিকিৎসায়ও তিনি আরোগ্য দান করতে পারেন।
আমি ১৩৮২ হিজরীতে রিয়াদ এসেছিলাম। সেখান থেকে পরে মক্কায় চলে এসেছিলাম। মক্কাই তখন হয়ে উঠেছিলো আমার কাজকর্মের কেন্দ্রবিন্দু। রিয়াদে আমার এক বন্ধু ছিলেন। সিরিয়া থেকে এসেছিলেন। তিনি এবং তার মা সেখানে একসঙ্গে থাকতেন। একবার একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে আমার বন্ধুটির লেবানন যাওয়ার প্রয়োজন হলো। কিন্তু মা রাজি হচ্ছিলেন না। ছেলে চলে গেলে এখানে কীভাবে একলা ঘরে থাকবেন তিনি— এ সব ভাবছিলেন তিনি। এ দিকে ছেলে এ-সফরের ব্যাপারে অটল রইলো। যাই হোক; সফরের আগের দিন ছেলে ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে কোম্পানির কাছে তা হস্তান্তর করে বাসায় ফিরে এলেন। ফ্লাইট ছিলো ভোরে।
বাসায় কী ঘুম পেয়েছিলো তারে আল্লাহ মালুম। তিনি জাগলেন না। জাগতে পারলেন না। মা’ও তাকে জাগালেন না। বেশ পরে উঠে দেখেন— বিমান ছাড়ার নির্দ্ধারিত সময় বাকি আছে আর মাত্র পৌনে এক ঘন্টা। এখন তাহলে কী করা? তড়িঘড়ি করে তিনি ছুটলেন বিমানবন্দরের দিকে। যেতে যেতে দু‘আ করতে লাগলেন— বিমানটা যেনো তার পৌঁছার আগে আকাশে ওড়াল না দেয়! গাড়ি খুব দ্রুতই পৌঁছে গেলো বিমানবন্দরে। দেখলেন এখনো বিমান ছাড়তে বাকি আছে আধা ঘন্টা। তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বসলেন পেতে রাখা একটা চেয়ারে। অপেক্ষার নীরব প্রহরে হঠাৎ করেই তিনি হারিয়ে গেলেন আবারো সেই নিদ্রার কোলে।
বিমান ছাড়ার সময় হলো!
মাইকে ঘোষণাও দেয়া হলো!
তার নাম ধরে বারবার ডাকাও হলো!
কিন্তু তিনি উঠলেন না, শুনলেন না! শেষ পর্যন্ত বিমান তাকে রেখেই চলে গেলো!
পরে আমাকে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন :
— আল্লাহ্র কাছে এতো দু‘আ করলাম তিনি যেনো আমাকে বিমানটা মিলিয়ে দেন, তারপরও এমন হলো কেনো?
আমি তাকে সান্ত্বনা দিলাম। বললাম :
— আল্লাহ এমন ব্যক্তির দু‘আ কখনোই ফিরিয়ে দেন না, যে তাঁকে ডাকে হৃদয় থেকে। কিন্তু মানুষ কী উপকারী আর কী অপকারী তার বাছ-বিচার না করেই অনেক সময় দু‘আ করতে থাকে। কী উপকারী তা আল্লাহই অধিক ভালো জানেন।
বন্ধুটি আমার কথা মনে হয় হজম করতে পারেন নি। কিন্তু সেদিন কী ঘটেছিলো, বলবো? সেদিন বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছিলো! আরোহীদের সবাই মারা গিয়েছিলো! বুঝতেই পারছো, আমার বন্ধু যে বিমানটি হারিয়েছিলেন এটিই সেই বিমান! কল্পনা করো তো, এরপর আমার বন্ধু বিমান ফেল করায় কী পরিমাণ শোকর আদায় করেছিলেন?
অনেক সময় মানুষ নিজের জন্যে যা ক্ষতিকর, তাই আল্লাহর কাছে চেয়ে বসে। কিন্তু আল্লাহ তো মহান দয়ালু। তিনি ক্ষতিকর জিনিস তাকে দান করেন না। বাবা শিশুপুত্রকে নিয়ে দোকানে গেলে শিশুপুত্র এটা সেটা কিনতে চায়। তখন বাবা কি তাকে ক্ষতিকর কিছু কিনে দেন? খেলনা চাইলে খেলনা কিনে দেন। কিন্তু লাল প্যাকেটে মোড়ানো কোনো ওষুধ কি কিনে দেবেন ফার্মেসী থেকে? দেবেন না! কারণ তা পুত্রের জন্যে ক্ষতিকর। আল্লাহ তো মা বাবা’র চেয়ে অনেক অনে-ক বেশি দয়ালু! তাহলে তিনি কেনো বান্দাকে ক্ষতিকর জিনিস চাইলেই দিয়ে দেবেন?!
Copy By মুহতারাম শায়েখ Yahya Yusuf Nadwi
লেখক ও বিশিষ্ট শিশু সাহিত্য ও সীরাত গবেষক ও সফল অনুবাদক।
----------------------------------------
শায়খ আলী তানতাভী’র ভাষায়—
‘প্রিয় পাঠক! এখন আমি তোমাদেরকে একটা গল্প শোনাবো। গল্পটা এক আমেরিকান পরিবারের। সদস্য সংখ্যা— আটজন। বাবা মা ও ছয় সন্তান। বাবা কৃষক। বড়ো কর্মঠ মানুষ তিনি। শরীর স্বাস্থ্যও বেশ সুঠাম সুগঠিত। তার মনোবলও খুব আকাশছোঁয়া। যা করতে চান, তা করেই ফেলেন। আর মা ছিলেন বুদ্ধিমতি গুণবতি এক মহিলা। সাধারণ এক কৃষকের বউ হলেও গুণ-বুদ্ধি ও কৌশলে এবং বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতায় তিনি ছিলেন অনেকের চেয়ে সেরা। তাই ছেলে-মেয়েরা গড়ে উঠছিলো তার পরিকল্পিত তত্ত্বাবধানে। মায়ের কাছ থেকে তারা শিখছিলো— কীভাবে বড় হতে হয়। কীভাবে মানুষ হতে হয়। বিপদ এলে ধৈর্য ধরতে হয়। সব প্রতিকুল পরিস্থিতিকে জয় করে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। এমন বাবা মা’র লালন-প্রতিপালন ও তত্ত্বাবধানের ছায়ায় তাই ছেলেরা বেড়ে উঠলো পূর্ণ হয়ে। বড় হওয়ার আগেই তারা বড় হয়ে গেলো।
সবার ছোট্ট ভাইটি একদিন বাইরে খেলছিলো। বয়স আর কতো হবে, মাত্র তের। এ বয়সের খেলায় একটু দুরন্তপনা থাকেই। এ বালকও মেতে উঠেছিলো তেমন দুরন্তপনায়। একটা শিলাখণ্ড থেকে লাফ দিতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এসে পড়লো নিচে। পায়ে ও হাটুতে চোট লাগলো। প্রচণ্ড ব্যথা পেলো। ব্যথা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো। ওর বয়সী কোনো ছেলেই অমন ব্যথা সহ্য করতে পারতো না। কিন্তু ও সহ্য করলো। কাউকেই কিছু বুঝতে দিলো না। রাত গড়িয়ে সকাল এলো। ওর পাঠশালায় যাওয়ার সময় হলো। এ-ব্যথা নিয়ে পাঠশালায় না যাওয়াটাই স্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু ও গেলো এবং পায়ে হেঁটেই গেলো। এ দিকে ব্যথা বাড়ছিলো, তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিলো। ওর ধৈর্যও বাড়ছিলো। এভাবে দু’দিন কেটে গেলো। পা ফুলে গেলো। ব্যথার তীব্রতায় জায়গাটা নীল হয়ে গেলো। এক কদমও আর চলা সম্ভব হচ্ছিলো না। তখন মা-বাবা জানতে পারলেন এবং রাজ্যের শঙ্কা এসে ছায়া বিস্তার করলো তাদের চোখে-মুখে-অনুভবে। তারা ভীষণ অস্থির হয়ে পড়লেন। তাদের কলিজার পানি শুকিয়ে গেলো। তারা উদ্বেগভরে জানতে চাইলেন— ‘এ অবস্থা কী করে হলো?’ এবার ও সবকিছু জানালো। ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে। তখন তারা দ্রুত তাকে বিছানায় শুইয়ে দিলো এবং ডাক্তার ডাকতে বেরিয়ে গেলো। ডাক্তার এসে সব দেখলো। কিন্তু কোনো সুসংবাদ শোনাতে পারলো না। উল্টো দিলো এক মহা দুঃসংবাদ। বললো :
— চিকিৎসার সময় ফুরিয়ে গেছে! পা কেটে ফেলতে হবে! এবং করতে হবে তা এই মুহূর্তেই, নইলে তাকে বাঁচানো যাবে না। কেননা ওর রক্ত দূষিত হয়ে গেছে!
এ-সব মা-বাবাকে বলা হলো এক পাশে এনে কানে কানে, ছেলের অগোচরে। ডাক্তারের একেকটা কথা গিয়ে বিঁধছিলো বাবা-মা’র অনুভবে কাঁটার মতো! ছেলের পা কেটে ফেলতে হবে? এ কী করে সম্ভব! ও সারা জীবন পা-হারা থাকবে? কেমনে চলবে? তবুও বাস্তবতা মেনে নিতে হলো! ওর জীবনের মায়ায় পা কাটতে তারা রাজি হলেন। কাঁদতে কাঁদতে ছেলেকে গিয়ে বললেন :
— তোমার পা কেটে ফেলতে হবে দ্রুত, নইলে তোমাকে বাঁচানো যাবে না!
কিন্তু ছেলে আরো বেশি অপ্রস্তুত হয়ে গেলো এ কথা শোনে! ও পরিস্কার বলো দিলো— ‘না’! গলা ফাটিয়ে কেঁদে উঠলো! বললো :
— তোমরা আমার পা’টা কেটে ফেলো না! বাবা! তুমি আমাকে বাঁচাও! আমার পা কেটে ফেললে আমি হাটবো কেমন করে! বাবা! আমাকে রক্ষা করো! ডাক্তারকে এক্ষুনি চলে যেতে বলো!
ছেলেটা এক পায়ে ভর দিয়ে বিছানা ছেড়ে পালাতে চাইলো। কিন্তু বাবা ওকে ধরে ফেললেন। বিছানায় জোর করে শুইয়ে দিলেন। তখন ও আরো বেশি ভয় পেয়ে গেলো! ওর আর্তচীৎকার আরো বেড়ে গেলো—
— মা! আমাকে বাঁচাও! মা! আমার পা কাটতে দেবে না!
অশ্র“সিক্ত মা পাশে দাঁড়িয়েছিলেন নিথর হয়ে। কী করবেন তিনি? ছেলের ডাকে সাড়া দেবেন না ডাক্তারের উপদেশ মানবেন? তার হৃদয়টা হাহাকার করে উঠলো। কোন্ দিকে যাবেন তিনি? কিছুই বুঝতে পারছিলেন না! দাঁড়িয়ে রইলেন অশ্র“প্লাবিত দৃষ্টি নিয়ে আর ভেঙে যাওয়া হৃদয়ের সীমাহীন ব্যাকুলতা নিয়ে! হায়! তিনি যদি পারতেন ছেলের জন্যে নিজের জীবনটা বিলিয়ে দিতে!
ছেলেটার কান্না ও চীৎকার থামছেই না। মায়ের দিকে ও অশ্র“-করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আকুলি-বিকুলি করছিলো। পানিতে ডুবে যেতে যেতে মানুষ যেভাবে উদ্ধারকারীর উদ্দেশ্যে হাত পা ছুঁড়তে থাকে, ঠিক সেভাবে!
কিন্তু মায়ের আজ কী হয়ে গেলো? মা যে তার ডাকে সাড়া দিচ্ছেন না! মাও কি আজ পর হয়ে গেলেন, বাবার মতন? পৃথিবীর সবাই কি পর হয়ে গেলো? .......
বাবা’র পর ও মা’র ব্যাপারেও হতাশ হয়ে গেলো। এবার আরেকটা নাম ধরে ও চিৎকার করতে লাগলো। ওর বড় ভাইয়ের নাম! বেশি না, ওর চেয়ে সামান্য বড়। পিঠাপিঠি ভাই। এক সাথেই খেলে ওরা। যেনো সহপাঠি, বন্ধু! ও কি এখন সাড়া দেবে? আসবে কি ওকে বাঁচাতে? ওর পা’টাকে রক্ষা করতে? ইদগার! ইদগার! কোথায় তুমি ভাইয়া? এসো না! তুমিও কি আসবে না? তুমিও সবার মতো পর হয়ে যাবে?
ইদগার শুনলো ভাইয়ের আর্ত আবেদন! সাথে সাথে ঝড় উঠলো ওর ভ্রাতৃহৃদয়ে! ছুটেও এলো ঝড়ের গতিতে! এসে দাঁড়ালো ভাইয়ের কাছে, ওর দরোজার মুখে। তারপর? তারপর একটা কাপড় দিয়ে কোমরটা বাঁধলো! কী বলে যেনো বুকে দম করলো!
তারপর? তারপর ঘোষণা করলো—
— সাবধান! তোমরা এদিকে কেউ আসবে না! ওর পা কাটতে আমি দেবো না! ও এমনিতেই সেরে ওঠবে!!
বাবা কাছে এগিয়ে গেলেন! ইদগারকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, পারলেন না!
মা গেলেন, তিনিও পারলেন না! ইদগার যেনো কোনো ছোট্ট কিশোর নয়— এক বীরপুরুষ! এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে জীবনপণ লড়াইয়ে! একদিকে ওর ‘মাজলুম’ ভাই, অন্যদিকে একদল ‘হৃদয়হীন’ মানুষ! না! ইদগার আজ আপোষ করবে না! যে কোনো মূল্যে ভাইটিকে ‘দুষ্ট-স্পর্শ’ থেকে বাঁচাবে, বাঁচাবেই!
বাবা ইদগারকে কথার জোরে বোঝাতে না পেরে গায়ের জোরে সরিয়ে দিতে চাইলেন। পারলেন না! ইদগার ভাইয়ের জন্যে বাবাকে একদম খাতির করলো না। তাকে এবং ডাক্তারটাকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো!
অবাক লাগছে? না, অবাক হওয়ার কিছু নেই! ইদগার এখন সিংহ! যে কোনো মূল্যে এখন ও রক্ষা করতে চায় ভাইকে, তার পা’কে!
এখন সব মানুষ ওর কাছে পর— ভাইটি ছাড়া!
এখন সব মানুষ ওর দুশমন— ভাইটি ছাড়া!
এমন সঙ্গিন মুহূর্তে বিড়ালও হয়ে যায় বাঘ!
মুরগীর কথাই একটু ভাবো! মুরগীর কোনো বাচ্চার উপর কেউ হামলে পড়লে তখন মুরগীটি কেমন পাখনা ফুলিয়ে হামলাকারীকে তেড়ে যায়— দেখেছো কখনো! কিংবা বিড়ালের কথাই ধরো! বিড়াল যখন জীবনের আশা ছেড়ে দেয়, তখন কেমন করে দাঁত খিচিয়ে আক্রমণকারির উপর হামলে পড়তে উদ্ধত হয়— দেখেছো?! নিশ্চয়ই দেখেছো! মুরগীটি তখন হয়ে যায় একটা শিকারি বাজ আর বিড়ালটা হয়ে যায় একটা হিংস্র নেকড়ে! ইদগারের অবস্থাটাও তাই! এখন সে বীর! এখন দেয়াল টলে যেতে পারে কিন্তু ইদগার টলবে না। বাবা-মা এবং ডাক্তার অবস্থা বেগতিক দেখে চলে গেলেন। ভাবলেন— ধীরে ধীরে ইদগার শান্ত হয়ে আসবে। ক্লান্ত হয়ে, বিরক্ত হয়ে তাদের কথা মানতে বাধ্য হবে। ঘুম ও ক্ষুধার কাছে আত্মসমর্পণ করবে। কিন্তু বেলা গড়ানোর পরই বোঝা গেলো, তারা এক নতুন ইদগারের মুখোমুখি হয়েছে। এই ইদগারের সাথে কোনো কালেই তাদের পরিচয় ছিলো না। ও প্রায় না ঘুমিয়ে এবং না খেয়েই ভাইয়ের পাহারায় অবিচল রইলো। কেউ ওর ধারে কাছেও ভিড়তে পারলো না। ডাক্তার একটু পর পর এসে অবস্থা নিরীক্ষণ করছিলো নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে। ডাক্তার কাছে আসা মাত্রই ইদগারের লাল চোখ আরো লাল হয়ে ওঠে। এই লালের সামনে ডাক্তার টিকতে পারে না। অসহায় ভঙ্গিতে ফিরে যায়। হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফেলে। এদিকে ছেলেটার পা আরো ফুলে গেলো। সাথে সাথে নীলে নীল! ডাক্তার আর পারলো না। পুরোপুরি হাত গুটিয়ে নিলো। অশ্র“ভারে আক্রান্ত বাবা মা’র চোখে চোখ রেখে যাবার আগে শুধু বলে গেলো :
— পারা গেলো না! ছেলেটাকে আর বাঁচানো গেলো না! আমি চলে গেলাম! এখানে থেকে সময় নষ্ট করে লাভ নেই! এখন অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ওর পা কেটেও ওকে এখন আর বাঁচানো যাবে না। ওর সামনে অপেক্ষা করছে মৃত্যু। বেদনাময় নীল মৃত্যু!
ডাক্তার চলে যাওয়ার পর বাড়ির পরিবেশটা আরো ভারি হয়ে উঠলো। ছলোছলো নীরব দৃষ্টির ভাঁজে ভাঁজে ঝরে পড়তে লাগলো নীল বেদনা ও হতাশা! সেখানে নেই এখন কোনো আলো। একটু আগে ডাক্তার আশার ক্ষীণতম আলোটিও নিভিয়ে রেখে গেছে!
কঠিন বিপদের মুহূর্তে মানুষ কী করে?
আসলে মানুষ যখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়ায়, মানুষ যখন জীবনের আশা একেবারেই ছেড়ে দেয়, তখন সে আল্লাহর কাছে ফিরে আসে। মু’মিন হোক কিংবা কাফের। মু’মিন তো তখন ফিরে আসেই, কাফেরও ফিরে আসে। কারণ সব মানুষের হৃদয়েই ঈমান লুকিয়ে আছে। এমনকি কট্টর কাফেরের হৃদয়েও। এ জন্যেই আরবী ভাষায় ‘কাফির’ মানে ‘সাতির’। আর সাতির মানে যে নিজের ভিতরে ঈমানকে লুকিয়ে রাখে। যদিও সে ভাবে— তার ভিতরে ঈমান বলতে কিছু নেই। এ জন্যেই বিপদের কঠিন মুহূর্তে লুকিয়ে থাকা সেই ঈমানটাই জেগে ওঠে। কুফরির আবরণ ছাপিয়ে উদিত হয় ঈমানের সেই আলোটা। তাকে দেখায় সঠিক পথ। নিয়ে যায় আল্লাহর আশ্রয়ে। তাকে বাধ্য করে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করতে।
কুরাইশরা মূর্তিপূজা করতো। হোবল-লাত-উয্যা’র উপাসনা করতো। কিন্তু কখন? যখন থাকতো না বিপদ ও সঙ্কট। মূর্তি দুর্বল, কিছুই করার ক্ষমতা ওরা রাখে না— এ বিশ্বাসই ওদের ভিতরে কাজ করতো। তারপরও পূর্ব পুরুষের দোহাই টেনে টেনে ওরা মূর্তিপূজা করতো। কিন্তু যখন আসতো বিপদ ও সঙ্কট! যখন বইতো ঝড় ও তার তাণ্ডব, তখন কী করতো ওরা?
বাণিজ্যিক ভ্রমণে নৌকায় আরোহন করতে হতো ওদেরকে প্রায়ই। তখন সমুদ্র-ঝড়ে পড়লে কী করতো ওরা? যে ঝড়ে নৌকা নিয়ে ঢেউ খেলা করে ঠিক সেভাবেই, যেভাবে ঘূর্ণিবায়ূ খেলা করে পাখির পালক নিয়ে? সেই সঙ্কটকালে তারা কার কাছে আত্মসমর্পণ করতো? লাত-ওয্যা ও হোবলের কাছে নাকি আল্লাহ্র কাছে? না! তখন লাত-ওয্যা ও হোবলের কোনো মূল্য ছিলো না তাদের কাছে, তারা বরং তখন আশ্রয় নিতো আল্লাহর কাছে। তখন সেই লুক্বায়িত ঈমান জ্বলে উঠতো তাদের হৃদয়ে। পরিত্যক্ত হতো লাত উয্যা ও হোবল মানাত। যতো বড় কাফেরই হোক, নৌকাডুবি হলে এবং অথৈ পানিতে কিছু একটা ধরে বেঁচে থাকার চেষ্টাকালে হৃদয় থেকেই ভেসে আসে এই আর্ত আকুতি— হে আল্লাহ! হে আসমান জমিনের মালিক! আমাকে বাঁচাও!
ফেরাউনের সলীল-সমাধি’র কালো ইতিহাস আমাদেরকে কী বলে? অহঙ্কারী ফেরাউন ডুবে যাওয়ার মুহূর্তে কী বলেছিলো? বলেছিলো কি— ‘আমিই সবচে’ বড় প্রভু’? না বলে নি! বলতে পারে নি! কেননা ফেরাউনের হৃদয়ের গভীরেও ঈমানের বীজ লুকিয়ে ছিলো! মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে তাই তার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিলো—
﴿ آمَنتُ أَنَّهُ لا إِلِـهَ إِلاَّ الَّذِي آمَنَتْ بِهِ بَنُو إِسْرَائِيلَ وَأَنَاْ مِنَ الْمُسْلِمِينَ ﴾
‘আমি ঈমান আনলাম যে নেই কোনো ইলাহ সেই সত্তা ছাড়া, যার প্রতি ঈমান এনেছে বনী ইসরাঈল। আর আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত।’
মনে করো, তুমি মরুভূমিতে সফর করছো। প্রচণ্ড পিপাসায় ছটফট করছো। পান করার মতো এক কাতরা পানিও নেই। মৃত্যু ধেয়ে আসছে চারদিক থেকে তোমার দিকে। তখন তুমি কী করবে? ডেকে ওঠবে না কি আর্তনাদ করে— ‘হে আল্লাহ! হে আল্লাহ!!’ বলে?!
যখন নেমে আসে দুর্ভিক্ষ কিংবা অনাবৃষ্টি। চারদিকে কেবল হাহাকার। ‘নেই নেই’ হাহাকার। নেই পানি, নেই খাবার! তখন কার কাছে মানুষ ফিরে যায়? আল্লাহর কাছেই ফিরে যায়!
তুমুল যুদ্ধের সময় মৃত্যু যখন সামনে এসে হাজির হয়, তখন কার কাছে মানুষ আশ্রয় চায়?
সব চিকিৎসা এবং সকল ডাক্তার যখন ব্যর্থ হয়ে যায়, তখন কার কাছে মানুষ ফিরে যায়?
আল্লাহ্র কাছে! অবশ্যই আল্লাহ্র কাছে!!
তখন আল্লাহদ্রোহী আল্লাহর সাথে দ্রোহ করতে ভুলে যায়!
তখন বস্তুবাদী বস্তুবাদে বিশ্বাস করে না।
নাস্তিকও তখন আস্তিক হয়ে যায়! সবাই সমকণ্ঠে বলে ওঠে—
আল্লাহ! আমার আল্লাহ! আমাকে বাঁচাও! আমাকে উদ্ধার করো! আমাকে এবারের মতো মাফ করে দাও!!
ডাক্তার চলে গেলো!
তারপর কী হলো?
তারপর হতাশার অন্ধকারে সব হারিয়ে গেলো!
অসুস্থ ভাইটি হতাশ! ইদগারও হতাশ! বাবা-মা আরো বেশি হতাশ! ডাক্তার আরো বড় হতাশ!
এই হতাশার অন্ধকারে কোনো আলো দেখা গেলো না! আলোর ছিটে-ফোঁটাও না!
সবাই উপায়হীন! সবাই সম্বলহীন!
সবাই অসহায়! দিকভ্রান্ত!
তখন, হ্যাঁ তখনই সবার হাত উঠে গেলো আকাশের দিকে! এক আল্লাহ্র দিকে! তাঁর কাছেই চাইলো সবাই আরোগ্য! শুধু তাঁর কাছেই! নিরুপায়ের একমাত্র উপায় তো তিনিই! নিরুপায় যখন ‘হে আল্লাহ!’ বলে, তখন আল্লাহ্র বলেন : ‘কী হয়েছে আমার বান্দা! বলো, জলদি বলো! আমি হাজির!’ আল্লাহ তখন নিরুপায়কে ফিরিয়ে দেন না। কাফের কিংবা ফাসেক বলে তাকে রাগ করে দূরে ঠেলে দেন না! যে-ই তাঁর দরোজায় হাজির হয় তাকেই তিনি আশ্রয় দেন! তাঁর দরোজা সবার জন্যে খোলা! চির অবারিত! তবে দুনিয়ার কাফের মুশরিকদেরকে তিনি শুধু দুনিয়াই দেন, আখেরাতের কোনো আবদার তিনি রক্ষা করেন না। কেননা, এরা আখেরাতকে বিশ্বাস করে না!
অশ্রুময় ও হৃদয়োৎসারিত প্রার্থনা শেষে দেখা গেলো যে ফোলা ভাবটা অনেকটাই কমে আসছে! বেদনার নীলচে রঙটাও ধীরে ধীরে দূর হয়ে যাচ্ছে! ব্যথাও আগের চেয়ে অনেক কম এবং কমছেই! দু’দিন শেষে পা’টা একেবারেই ভালো হয়ে গেলো!!
রোগী অবাক!
ইদগার অবাক!
মা-বাবা আরো অবাক!
পরিবারের সবাই অবাক!
আর ডাক্তারের চোখ তো একেবারে ছানাবড়া!
সব শোনে এবং সব দেখে সে কোনো হিসাব মেলাতে পারছিলো না!
বন্ধুরা! কী ভাবছো? এ কি কল্পকাহিনী না বাস্তব সত্য? আগেই বলেছি বাস্তব সত্য! কেমন হয়, যদি বলে দিই গল্পের ‘নায়ক’-এর পরিচয়টা? তিনি হলেন দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের মিত্র বাহিনীর সেনাপতি! সুতরাং বুঝতেই পারছো, জগত জোড়া অনেক ছিলো তার খ্যাতি। তার নাম— অ্যাইজেনহাওয়ার (ঊরংবহযড়বিৎ)। তার আরেকটা বড় পরিচয় আছে। পরবর্তীতে তিনি আমেরিকার (৩৪ নাম্বার) প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত হয়েছিলেন। সুতরাং বলতেই হবে— আল্লাহ সবকিছু পারেন। ওষুধের মাধ্যমে তিনি যেমন সুস্থতা দান করতে পারেন তেমনি বিনা ওষুধ ও বিনা চিকিৎসায়ও তিনি আরোগ্য দান করতে পারেন।
আমি ১৩৮২ হিজরীতে রিয়াদ এসেছিলাম। সেখান থেকে পরে মক্কায় চলে এসেছিলাম। মক্কাই তখন হয়ে উঠেছিলো আমার কাজকর্মের কেন্দ্রবিন্দু। রিয়াদে আমার এক বন্ধু ছিলেন। সিরিয়া থেকে এসেছিলেন। তিনি এবং তার মা সেখানে একসঙ্গে থাকতেন। একবার একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে আমার বন্ধুটির লেবানন যাওয়ার প্রয়োজন হলো। কিন্তু মা রাজি হচ্ছিলেন না। ছেলে চলে গেলে এখানে কীভাবে একলা ঘরে থাকবেন তিনি— এ সব ভাবছিলেন তিনি। এ দিকে ছেলে এ-সফরের ব্যাপারে অটল রইলো। যাই হোক; সফরের আগের দিন ছেলে ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে কোম্পানির কাছে তা হস্তান্তর করে বাসায় ফিরে এলেন। ফ্লাইট ছিলো ভোরে।
বাসায় কী ঘুম পেয়েছিলো তারে আল্লাহ মালুম। তিনি জাগলেন না। জাগতে পারলেন না। মা’ও তাকে জাগালেন না। বেশ পরে উঠে দেখেন— বিমান ছাড়ার নির্দ্ধারিত সময় বাকি আছে আর মাত্র পৌনে এক ঘন্টা। এখন তাহলে কী করা? তড়িঘড়ি করে তিনি ছুটলেন বিমানবন্দরের দিকে। যেতে যেতে দু‘আ করতে লাগলেন— বিমানটা যেনো তার পৌঁছার আগে আকাশে ওড়াল না দেয়! গাড়ি খুব দ্রুতই পৌঁছে গেলো বিমানবন্দরে। দেখলেন এখনো বিমান ছাড়তে বাকি আছে আধা ঘন্টা। তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বসলেন পেতে রাখা একটা চেয়ারে। অপেক্ষার নীরব প্রহরে হঠাৎ করেই তিনি হারিয়ে গেলেন আবারো সেই নিদ্রার কোলে।
বিমান ছাড়ার সময় হলো!
মাইকে ঘোষণাও দেয়া হলো!
তার নাম ধরে বারবার ডাকাও হলো!
কিন্তু তিনি উঠলেন না, শুনলেন না! শেষ পর্যন্ত বিমান তাকে রেখেই চলে গেলো!
পরে আমাকে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন :
— আল্লাহ্র কাছে এতো দু‘আ করলাম তিনি যেনো আমাকে বিমানটা মিলিয়ে দেন, তারপরও এমন হলো কেনো?
আমি তাকে সান্ত্বনা দিলাম। বললাম :
— আল্লাহ এমন ব্যক্তির দু‘আ কখনোই ফিরিয়ে দেন না, যে তাঁকে ডাকে হৃদয় থেকে। কিন্তু মানুষ কী উপকারী আর কী অপকারী তার বাছ-বিচার না করেই অনেক সময় দু‘আ করতে থাকে। কী উপকারী তা আল্লাহই অধিক ভালো জানেন।
বন্ধুটি আমার কথা মনে হয় হজম করতে পারেন নি। কিন্তু সেদিন কী ঘটেছিলো, বলবো? সেদিন বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছিলো! আরোহীদের সবাই মারা গিয়েছিলো! বুঝতেই পারছো, আমার বন্ধু যে বিমানটি হারিয়েছিলেন এটিই সেই বিমান! কল্পনা করো তো, এরপর আমার বন্ধু বিমান ফেল করায় কী পরিমাণ শোকর আদায় করেছিলেন?
অনেক সময় মানুষ নিজের জন্যে যা ক্ষতিকর, তাই আল্লাহর কাছে চেয়ে বসে। কিন্তু আল্লাহ তো মহান দয়ালু। তিনি ক্ষতিকর জিনিস তাকে দান করেন না। বাবা শিশুপুত্রকে নিয়ে দোকানে গেলে শিশুপুত্র এটা সেটা কিনতে চায়। তখন বাবা কি তাকে ক্ষতিকর কিছু কিনে দেন? খেলনা চাইলে খেলনা কিনে দেন। কিন্তু লাল প্যাকেটে মোড়ানো কোনো ওষুধ কি কিনে দেবেন ফার্মেসী থেকে? দেবেন না! কারণ তা পুত্রের জন্যে ক্ষতিকর। আল্লাহ তো মা বাবা’র চেয়ে অনেক অনে-ক বেশি দয়ালু! তাহলে তিনি কেনো বান্দাকে ক্ষতিকর জিনিস চাইলেই দিয়ে দেবেন?!
Copy By মুহতারাম শায়েখ Yahya Yusuf Nadwi
লেখক ও বিশিষ্ট শিশু সাহিত্য ও সীরাত গবেষক ও সফল অনুবাদক।
Saturday, June 4, 2016
জীবনের হিসাব-নিকাশে _মুহাম্মাদ আলী সকলের জন্য গুরুপ্তপুর্ন
জীবনের হিসাব-নিকাশে মুহাম্মাদ আলী।
জনপ্রিয় কিংবদন্তি বক্সিং খেলোয়াড় এবং খেলাধুলার জগতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হেভিওয়েট বিবেচিত মোহাম্মদ আলী আজ ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। জীবনের হিসেব-নিকেশ, জীবন এবং মৃত্যুর প্রকৃত বাস্তবতা সম্পর্কে স্বচ্ছ চিন্তার দেখা মেলে তাঁর বক্তব্যে। মৃত্যু পরবর্তী জীবনে জান্নাতের নিয়ামাহ এবং পুরষ্কার লাভের তীব্র আকাঙ্ক্ষা সত্যিই ঈর্ষনীয়।
আলোচনা টির সম্পূর্ণ বঙ্গানুবাদ।
--মোহাম্মদ, আমি জানতে চাই, বক্সিং থেকে অবসর নেওয়ার পর আপনি কি করবেন?
(ঘুমানোর অভিনয় করছেন) ........আমি চেষ্টা করছি তাকে জাগিয়ে তোলার।
-- আমি ঘুমাবো, শুধুই ঘুমাবো। যখন আমি বক্সিং থেকে অবসরে যাবো, আমি আসলে জানি না, আমি এখানে আপনাদেরকে কিছু কথা বলতে চাই। এটা হয়তো আপনাদের চিন্তার খোরাক হতে পারে। জীবন আসলে তেমন বড় নয়। ৩০ বছরের একজন সাধারণ মানুষের কথাই ধরুন। আপনার বয়স যদি এখন ৩০ বছর হয়, তাহলে আসলে আপনার বয়স ৭ বছর। দেখুন আমি কিভাবে এটা প্রমাণ করি। ৩০ বছরের সাপেক্ষে আপনার প্রতিদিনের ৭/৮/৯ ঘন্টা ঘুমকে হিসাব করুন । গত রাতে আপনি বিছানায় গিয়েছেন এরপর সকালে ঘুম থেকে জেগেছেন। মাঝখানের কিছু আপনার মনে নেই। আপনি অচেতন ছিলেন প্রায় ৮ বছর, যদি আপনার বয়স হয় ৩০ বছর, আপনি ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন ৮ বছর। এই ৩০ বছরে কি পরিমাণ ভ্রমণ আপনি করেছেন ? টেলিভিশন স্টেশন থেকে বাসায় অথবা অন্য কোন দেশে, অন্য কোন শহরে, অথবা স্কুলে, চার্চে। সম্ভবত আপনার জীবনের ২ বছর কেটেছে ভ্রমণ করে, গন্তব্যস্থলে আসা-যাওয়া করে। সুতরাং ৮ বছর ঘুমানো, ২ বছর ভ্রমণ। এরপর আছে আপনার জীবনে এই অধ্যায় যখন আপনি কিছু অর্জন করতে চান। কতসময় আপনি স্কুলে বসে কাটিয়ে দিয়েছেন ? আমেরিকাতে আমরা স্কুল করি ক্লাস ওয়ান থেকে দ্বাদশ ক্লাস পর্যন্ত। এখানেও কি একই নিয়ম ? হ্যাঁ, মোটামুটি একই। দিনে ৬ ঘন্টা ? হ্যাঁ। দিনে ৬ ঘন্টা করে ১২ বছর। হিসাব করে দেখুন, আপনি অন্য কোথাও যাওয়া ছাড়া, ক্লাশরুমে বসে কাটিয়ে দিয়েছেন ৩ বছর। ২ বছর ভ্রমণে, ৮ বছর ঘুমিয়ে, ৩ বছর স্কুল করে। কত মুভি আপনি দেখেছেন, কতগুলো রেসলিং খেলা, কত পরিমাণ বিনোদন, কতগুলো সিনেমা হল, বেইসবল খেলা ? সম্ভবত ২ বছর বিনোদন। সুতরাং, যেই সময়ের মধ্যে আপনার সন্তান হয়, - খেয়াল করুন আমি কি বলছি - যেই সময়ের মধ্যে আপনি আপনার সন্তানের জন্য নির্ভরযোগ্য কোন ব্যবস্থা করেন, যেই সময়ের মধ্যে আপনি আপনার বাসস্থানের জন্য খরচ পরিশোধ করেন, ততদিনে আপনার বয়স ৬০ বছর। সুতরাং, জীবন আসলেই অনেক ছোট।
আপনি যদি আপনার সকল ভ্রমণ, ঘুম, স্কুল, বিনোদন যোগ করেন, সম্ভবত জীবনের অধর্েক সময় আপনি কিছু না করেই কাটিয়ে দিয়েছেন। এখন আমার বয়স ৩৫ বছর। আরও ৩০ বছর পরে আমার বয়স হবে ৬৫। ঐ বয়সে আমাদের আর কোন প্রভাব থাকে না, আমরা ৬৫ বছর বয়সে তেমন কিছুই করতে পারি না। আপনার স্ত্রীও আর ভালোবাসবে না। সুতরাং আমি যা বলতে চাই, আপনার বয়স যদি ৬৫ বছর হবে, আপনাকে আরও অনেক কিছু করতে হবে। আপনারা জানেন, ৩০ বছর পরে আমার বয়স হবে ৬৫। এই ৩০ বছর বয়সে আমাকে ৯ বছর ঘুমাতে হবে। আমি ৩০ বছর শুধুমাত্র দিন পাবো না। আমাকে ভ্রমণ করতে হবে। সম্ভবত পরবর্তী ৩০ বছরের মধ্যে আমাকে ৪ বছর কাটাতে হবে ভ্রমণ করে। ৯ বছর ঘুমিয়ে, টেলেভিশন, বিনোদন ইত্যাদির জন্য ৩ বছর। আমার ছিল ৩০ বছর, এর মধ্যে সম্ভবত আমি ১৬ বছর পাবো গঠণমূলক কিছু করার জন্য। সুতরাং এভাবে আমাদের প্রত্যেকের জীবনই ভেঙ্গে হিসেব করা যায়।
আমি আমার পরবর্তী ১৬ বছরে কি করবো ? সর্বোত্তম কোন কাজটি আমার করা উচিৎ ? সৃষ্টিকর্তার সাক্ষাতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। রিয়াল স্টেইটের মালিক হওয়া, ব্যাবসা করা, বক্সিং শিখানো— এগুলো আমাকে জান্নাত দিবে না। কতজন এখানে বিশ্বাস করেন যে একজন সর্বশ্রেষ্ঠ সত্তা আছেন, একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন ? কতজন বিশ্বাস করেন যে, কোন এক শক্তি আছে যা সৃষ্টি করেছে চাঁদ, সূর্য, তারা ? কতজন বিশ্বাস করেন যে, এই জিনিসগুলো এমনি এমনিই তৈরী হয় নি, কেউ একজন এগুলোকে সৃষ্টি করেছেন ? কতজন বিশ্বাস করেন যে একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন ? কতজন বিশ্বাস করেন যে কোন সৃষ্টিকর্তা নেই ? আমি যদি আপনাদের বলি যারা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করেন না, এই গ্লাস নিজে থেকেই অস্তিত্ব লাভ করেছে, এই গ্লাস নিজেকেই নিজে তৈরী করেছে, কোন মানুষ এই গ্লাস তৈরী করেনি, আপনি কি এটা বিশ্বাস করবেন ? আপনি কি এটা বিশ্বাস করবেন যে এটা নিজেকে নিজে তৈরী করেছে ? না। আমি যদি বলি আপনারা বিশ্বাস করবেন না, ঠিক? আমি বলছি সে বিশ্বাস করবে না। আমি যদি বলি যে, এই টেলিভিশন স্টেশন এমনি এমনিই অস্তিত্ব লাভ করেছে, কোন মানুষ এটাকে তৈরী করেনি, আপনারা বলবেন মোহাম্মাদ আলীর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ঠিক আছে, যদি এই গ্লাস এটাকে তৈরী করতে না পারে, যদি আমি আপনাকে বলি, আপনি যে পোশাক পরিধান করে আছেন, তা নিজেই নিজেকে তৈরী করেছে, আপনি মোটেই বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু আপনার পোশাক যদি নিজেকে তৈরী করতে না পারে, যদি এই গ্লাস নিজেকে তৈরী করতে না পারে, যদি এই বিল্ডিং নিজেকে তৈরী করতে না পারে, তাহলে কিভাবে চাঁদ তৈরী হলো ? কিভাবে নক্ষত্রপুঞ্জ, জুপিটার, নেপচুন, মঙ্গলগ্রহ, সূর্য, কিভাবে এই প্রকৃতি, কিভাবে এতসব কিছু আসলো ? যদি না কোন মহাজ্ঞানী সত্তা পরিকল্পনা করে এটা বানিয়েছেন। সুতরাং, আমি যা বলছি তা হলো, আমি বিশ্বাস করি যে আমরা বিচারের সম্মুখীন হবো। এত ইহুদি হত্যা করার পরেও হিটলারের মতো মানুষের কি পার পেয়ে যাওয়া যুক্তিসঙ্গত ? তাকে শাস্তি দেয়ার জন্য আবশ্যই কেউ থাকার কথা। এখানে সেই শাস্তি ভোগ না করলেও মৃত্যুর পরে সে এটা ভোগ করবে। শাস্তি হবে চিরকালীন। সুতরাং, আমি যা করবো যখন আমি অবসরে যাবো, তা হচ্ছে নিজেকে তৈরী করা সৃষ্টিকর্তার সাথে সাক্ষাতের জন্য। কারণ, আমার প্লেন দুর্ঘটনায় পড়তে পারে। এখানে কি বিমান বিস্ফোরণ হয় না ? মানুষ কি প্রতি দিনই মারা যাচ্ছে না ?
এটা চিন্তা করা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর যে, আমি জাহান্নামে যাবো চিরকালের জন্য, আগুনে দগ্ধ হওয়া অনন্তকালের জন্য ! সুতরাং আমি যা করবো,(আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছে, আমি জবাব দিচ্ছি) আমি যখন অবসর নিবো, আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করবো মানুষকে সাহায্য করার জন্য। এই জন্যই আমি এখানে(ইংল্যান্ড) জনি ওয়াকার এর সাথে। একজন দরিদ্র মানুষ এসেছে, এখানে কতিপয় তরুণ যাদের অর্থের প্রয়োজন। আর কেউ আমাকে আহ্বান করছে তাদেরকে সাহায্য করার জন্য। সৃষ্টিকর্তা আমাকে দেখছেন। সৃষ্টিকর্তা আমার প্রশংসা এজন্য করেন না যে আমি জো ফ্রেইযারকে (আরেকজন বিখ্যাত বক্সার) হারিয়েছি। তাকে হারানোতে আল্লাহ কিছু দিবেন না। আমরা যতদূর জানি, ইংল্যান্ড বা আমেরিকাকে আল্লাহ গুরুত্ব দেন না। কারণ সবকিছুই তাঁর। তিনি দেখতে চান আমরা একে অপরের সাথে কেমন ব্যবহার করি, কিভাবে আমরা একে অপরকে সাহায্য করি। তাই, আমি আমার জীবনকে উৎসর্গ করতে চাই, আমার নাম এবং সুনামকে ব্যবহার করে দানশীলতায় সহায়তা করার জন্য, মানুষকে সহায়তা করার জন্য, মানুষের মাঝে ঐক্য ও সংহতি তৈরীর জন্য। মানুষ একে অপরকে বোমা মারছে ভুল ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে। পৃথিবীতে আমাদের এমন কাউকে দরকার শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য। তাই, আমি যদি মারা যাই, আর যদি জান্নাত থাকে, আমি তা দেখতে চাই। কারণ, আমরা কয় দিনইবা বঁাচি, ৮০ বছর ? এই রুমের প্রত্যেকেই, আপনাদের মধ্যে কেউ মারা যাবে ২০ বছর পরে, কেউ মারা যাকে ৫০ বছর পরে, কেউ মারা যাবে ৩০, ৬০ অথবা ৭০ বছর পরে। আমরা সবাই খুব শীঘ্রই মারা যাবো। আর, ধরে নিলাম, যদি আপনি বঁাচেন ১২৫ বছর, যা আসলে আমাদের পক্ষে সম্ভব না, তাই না ? ধরুন, আমরা বাচিঁ ২৫০ বছর, আর আপনি এর মধ্যে ইন্দ্রীয় সুখ উপভোগ করেছেন ১৪৫ বছর, এর পরেও সেই জীবনের অবসান হবে। সুতরাং, আমাদের এই পৃথিবীতে ৮০ বছরের মতো সময়ও নেই। এটা একটা পরীক্ষা তা দেখার জন্য যে কোথায় আমাদের পরিণতী হবে জান্নাত নাকি জাহান্নাম। এটাই প্রকৃত জীবন নয়। আপনার আসল সত্তা হলো আপনার ভিতরে, আপনার দেহ বৃদ্ধ হয়ে যায়। একসময় আপনি দেখবেন আপনার দঁাত নেই, আপনার চুল পড়ে যাচ্ছে, দেহ অবসন্ন হয়ে আসছে। কিন্তু আপনার আত্মা কখনো মরে না। এটা চিরকাল জীবিত থাকবে। সুতরাং আপনার দেহ শুধুমাত্র আপনার আত্মাকে বহন করছে।
সুতরাং, সৃষ্টিকর্তা আমাদের পরীক্ষা করছেন এটা দেখার জন্য যে, কিভাবে আমরা অন্যের সাথে আচরণ করি, জান্নাতে আমাদের প্রকৃত বাসস্থানের অধিকারী হতে পারি। সুতরাং, এই বস্তুগত উপকরণাদি বেশিদিন টিকে না। এই বিল্ডিং টিকে থাকা অবস্থাতেই এর নির্মাতা মানুষটি মারা যাবে। ইংল্যান্ডে আনেক রাজা-রাণী ছিলেন, তারা সবাই মারা গেছেন। একজনের পরে আরেকজন আসবে। সুতরাং, আমরা এখানে চিরকাল অবস্থান করবো না। আমরা শুধুমাত্র সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক, আমরা কোন কিছুর অধিকারী নই। এমনকি আপনার সন্তানরাও আপনার নয়। আপনি মনে করছেন আমি মিথ্যা বলছি ? আপনার স্ত্রী আসলে আপনার নয়। আপনি মারা যান আর এরপর একবছর পরে ফিরে এসে আপনার বেডরুমে ঘুমাতে যান আর দেখুন আপনার স্ত্রী কি আপনার থাকে কিনা। আপনি আপনার স্ত্রীর অধিকারী নন। আমি আমার স্ত্রীকে তালাক দিয়েছি, হয়তো আপনারা এ ব্যাপারে পড়েছেন। আমার চার সন্তান এখন অন্য আরেকজনকে বাবা ডাকে। তারা এখন আর আমাকে দেখে না। আপনি আপনার সন্তানদের অধিকারী নন। আপনি আপনার পরিবারের অধিকারী নন। তাই, আমি যা বলছি, জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূণর্ বিষয় হলো, কি ঘটবে আপনি যখন মারা যাবেন, আপনি কি জান্নাতে যাবেন নাকি জাহান্নামে। আর এটা হবে অনন্তকালের।
অনন্তকাল কি পরিমাণ সময় ? উদাহরণ হিসেবে সাহারা মরুভূমিকে নিতে পারেন। সাহারা মরুভূমিতে অনেক বালি তাই না ? ধরুন, একটা বালির কণা হলো ১০০০ হাজার বছরের প্রতীক। আর যখন আপনি জাহান্নামে দগ্ধ হবো, তা হবে চিরকালেন জন্য, চিরকাল এবং চিরকাল, কোন শেষ নেই। কত লম্বা সময় তা ? আপনাদেরকে একটা ধারণা দেই অনন্তকাল কত লম্বা। আমি আপনাদেরকে বলেছি সাহার মরুভূমির থেকে প্রতি ১০০০ বছরে একটা করে বালির কণা নিতে থাকুন যতক্ষণ না মরুভূমি খালি হয়ে যায়। ঠিক আছে, অপেক্ষা করুন ১০০০ বছর, তারপর একটি বালির কণা তুলে নিন। পরবর্তী কণা নেওয়ার আগে আরও ১০০০ বছর অপেক্ষা করুন। কণা তুলতে থাকুন যতক্ষণ না মরুভূমিতে আর কোন বালি না থাকে। আপনি জানেন এটা কত লম্বা সময় ? আমেরিকার বয়স ২০০ বছরও না। ১০০০ বছর পূর্ণ করতে আমাদেরকে আরও ৮০০ বছর পার করতে হবে। সুতরাং, এই চিন্তা আমাকে আতঙ্কিত করে যে, আমি একদিন মারা যাবো আর এরপর জাহান্নামে যাবো। আমি এরোপ্লেনে আছি আর এটা যেকোন সময় বিস্ফোরিত হতে পারে, আমি সবসময় ভ্রমণ করছি। সৃষ্টিকর্তা আমার বিচার করবেন। আমি মানুষ হত্যা করতে পারি, আমি ডাকাতি করতে পারি। প্রশাসন আমাকে নাও ধরতে পারে, এফ. বি. আই. স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডও হয়তো আমাকে নাও ধরতে পারে। কিন্তু যখন আমি মারা যাবো, কেউ একজন আমাকে দেখছেন এবং হিসাব রাখছেন আর আমি তা থেকে পালাতে পারবো / রেহাই পেতে পারবো না। আর আমি আগুনে দগ্ধ হতে চাই না চিরকাল, চিরকাল এবং চিরকালের জন্য, আমি জান্নাতে যাবো। তাই, আমি বক্সিং থেকে অবসরের পরে যা করবো, পরবর্তী ১৬ বছরের গঠনমূলক সময়ে আমি নিজেকে তৈরী করবো যাতে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য পেতে পারি এবং সর্বোত্তম স্থানে যেতে পারি। এটা কি যুক্তিসঙ্গত মনে হয় ?
জনপ্রিয় কিংবদন্তি বক্সিং খেলোয়াড় এবং খেলাধুলার জগতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হেভিওয়েট বিবেচিত মোহাম্মদ আলী আজ ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। জীবনের হিসেব-নিকেশ, জীবন এবং মৃত্যুর প্রকৃত বাস্তবতা সম্পর্কে স্বচ্ছ চিন্তার দেখা মেলে তাঁর বক্তব্যে। মৃত্যু পরবর্তী জীবনে জান্নাতের নিয়ামাহ এবং পুরষ্কার লাভের তীব্র আকাঙ্ক্ষা সত্যিই ঈর্ষনীয়।
আলোচনা টির সম্পূর্ণ বঙ্গানুবাদ।
--মোহাম্মদ, আমি জানতে চাই, বক্সিং থেকে অবসর নেওয়ার পর আপনি কি করবেন?
(ঘুমানোর অভিনয় করছেন) ........আমি চেষ্টা করছি তাকে জাগিয়ে তোলার।
-- আমি ঘুমাবো, শুধুই ঘুমাবো। যখন আমি বক্সিং থেকে অবসরে যাবো, আমি আসলে জানি না, আমি এখানে আপনাদেরকে কিছু কথা বলতে চাই। এটা হয়তো আপনাদের চিন্তার খোরাক হতে পারে। জীবন আসলে তেমন বড় নয়। ৩০ বছরের একজন সাধারণ মানুষের কথাই ধরুন। আপনার বয়স যদি এখন ৩০ বছর হয়, তাহলে আসলে আপনার বয়স ৭ বছর। দেখুন আমি কিভাবে এটা প্রমাণ করি। ৩০ বছরের সাপেক্ষে আপনার প্রতিদিনের ৭/৮/৯ ঘন্টা ঘুমকে হিসাব করুন । গত রাতে আপনি বিছানায় গিয়েছেন এরপর সকালে ঘুম থেকে জেগেছেন। মাঝখানের কিছু আপনার মনে নেই। আপনি অচেতন ছিলেন প্রায় ৮ বছর, যদি আপনার বয়স হয় ৩০ বছর, আপনি ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন ৮ বছর। এই ৩০ বছরে কি পরিমাণ ভ্রমণ আপনি করেছেন ? টেলিভিশন স্টেশন থেকে বাসায় অথবা অন্য কোন দেশে, অন্য কোন শহরে, অথবা স্কুলে, চার্চে। সম্ভবত আপনার জীবনের ২ বছর কেটেছে ভ্রমণ করে, গন্তব্যস্থলে আসা-যাওয়া করে। সুতরাং ৮ বছর ঘুমানো, ২ বছর ভ্রমণ। এরপর আছে আপনার জীবনে এই অধ্যায় যখন আপনি কিছু অর্জন করতে চান। কতসময় আপনি স্কুলে বসে কাটিয়ে দিয়েছেন ? আমেরিকাতে আমরা স্কুল করি ক্লাস ওয়ান থেকে দ্বাদশ ক্লাস পর্যন্ত। এখানেও কি একই নিয়ম ? হ্যাঁ, মোটামুটি একই। দিনে ৬ ঘন্টা ? হ্যাঁ। দিনে ৬ ঘন্টা করে ১২ বছর। হিসাব করে দেখুন, আপনি অন্য কোথাও যাওয়া ছাড়া, ক্লাশরুমে বসে কাটিয়ে দিয়েছেন ৩ বছর। ২ বছর ভ্রমণে, ৮ বছর ঘুমিয়ে, ৩ বছর স্কুল করে। কত মুভি আপনি দেখেছেন, কতগুলো রেসলিং খেলা, কত পরিমাণ বিনোদন, কতগুলো সিনেমা হল, বেইসবল খেলা ? সম্ভবত ২ বছর বিনোদন। সুতরাং, যেই সময়ের মধ্যে আপনার সন্তান হয়, - খেয়াল করুন আমি কি বলছি - যেই সময়ের মধ্যে আপনি আপনার সন্তানের জন্য নির্ভরযোগ্য কোন ব্যবস্থা করেন, যেই সময়ের মধ্যে আপনি আপনার বাসস্থানের জন্য খরচ পরিশোধ করেন, ততদিনে আপনার বয়স ৬০ বছর। সুতরাং, জীবন আসলেই অনেক ছোট।
আপনি যদি আপনার সকল ভ্রমণ, ঘুম, স্কুল, বিনোদন যোগ করেন, সম্ভবত জীবনের অধর্েক সময় আপনি কিছু না করেই কাটিয়ে দিয়েছেন। এখন আমার বয়স ৩৫ বছর। আরও ৩০ বছর পরে আমার বয়স হবে ৬৫। ঐ বয়সে আমাদের আর কোন প্রভাব থাকে না, আমরা ৬৫ বছর বয়সে তেমন কিছুই করতে পারি না। আপনার স্ত্রীও আর ভালোবাসবে না। সুতরাং আমি যা বলতে চাই, আপনার বয়স যদি ৬৫ বছর হবে, আপনাকে আরও অনেক কিছু করতে হবে। আপনারা জানেন, ৩০ বছর পরে আমার বয়স হবে ৬৫। এই ৩০ বছর বয়সে আমাকে ৯ বছর ঘুমাতে হবে। আমি ৩০ বছর শুধুমাত্র দিন পাবো না। আমাকে ভ্রমণ করতে হবে। সম্ভবত পরবর্তী ৩০ বছরের মধ্যে আমাকে ৪ বছর কাটাতে হবে ভ্রমণ করে। ৯ বছর ঘুমিয়ে, টেলেভিশন, বিনোদন ইত্যাদির জন্য ৩ বছর। আমার ছিল ৩০ বছর, এর মধ্যে সম্ভবত আমি ১৬ বছর পাবো গঠণমূলক কিছু করার জন্য। সুতরাং এভাবে আমাদের প্রত্যেকের জীবনই ভেঙ্গে হিসেব করা যায়।
আমি আমার পরবর্তী ১৬ বছরে কি করবো ? সর্বোত্তম কোন কাজটি আমার করা উচিৎ ? সৃষ্টিকর্তার সাক্ষাতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। রিয়াল স্টেইটের মালিক হওয়া, ব্যাবসা করা, বক্সিং শিখানো— এগুলো আমাকে জান্নাত দিবে না। কতজন এখানে বিশ্বাস করেন যে একজন সর্বশ্রেষ্ঠ সত্তা আছেন, একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন ? কতজন বিশ্বাস করেন যে, কোন এক শক্তি আছে যা সৃষ্টি করেছে চাঁদ, সূর্য, তারা ? কতজন বিশ্বাস করেন যে, এই জিনিসগুলো এমনি এমনিই তৈরী হয় নি, কেউ একজন এগুলোকে সৃষ্টি করেছেন ? কতজন বিশ্বাস করেন যে একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন ? কতজন বিশ্বাস করেন যে কোন সৃষ্টিকর্তা নেই ? আমি যদি আপনাদের বলি যারা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করেন না, এই গ্লাস নিজে থেকেই অস্তিত্ব লাভ করেছে, এই গ্লাস নিজেকেই নিজে তৈরী করেছে, কোন মানুষ এই গ্লাস তৈরী করেনি, আপনি কি এটা বিশ্বাস করবেন ? আপনি কি এটা বিশ্বাস করবেন যে এটা নিজেকে নিজে তৈরী করেছে ? না। আমি যদি বলি আপনারা বিশ্বাস করবেন না, ঠিক? আমি বলছি সে বিশ্বাস করবে না। আমি যদি বলি যে, এই টেলিভিশন স্টেশন এমনি এমনিই অস্তিত্ব লাভ করেছে, কোন মানুষ এটাকে তৈরী করেনি, আপনারা বলবেন মোহাম্মাদ আলীর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ঠিক আছে, যদি এই গ্লাস এটাকে তৈরী করতে না পারে, যদি আমি আপনাকে বলি, আপনি যে পোশাক পরিধান করে আছেন, তা নিজেই নিজেকে তৈরী করেছে, আপনি মোটেই বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু আপনার পোশাক যদি নিজেকে তৈরী করতে না পারে, যদি এই গ্লাস নিজেকে তৈরী করতে না পারে, যদি এই বিল্ডিং নিজেকে তৈরী করতে না পারে, তাহলে কিভাবে চাঁদ তৈরী হলো ? কিভাবে নক্ষত্রপুঞ্জ, জুপিটার, নেপচুন, মঙ্গলগ্রহ, সূর্য, কিভাবে এই প্রকৃতি, কিভাবে এতসব কিছু আসলো ? যদি না কোন মহাজ্ঞানী সত্তা পরিকল্পনা করে এটা বানিয়েছেন। সুতরাং, আমি যা বলছি তা হলো, আমি বিশ্বাস করি যে আমরা বিচারের সম্মুখীন হবো। এত ইহুদি হত্যা করার পরেও হিটলারের মতো মানুষের কি পার পেয়ে যাওয়া যুক্তিসঙ্গত ? তাকে শাস্তি দেয়ার জন্য আবশ্যই কেউ থাকার কথা। এখানে সেই শাস্তি ভোগ না করলেও মৃত্যুর পরে সে এটা ভোগ করবে। শাস্তি হবে চিরকালীন। সুতরাং, আমি যা করবো যখন আমি অবসরে যাবো, তা হচ্ছে নিজেকে তৈরী করা সৃষ্টিকর্তার সাথে সাক্ষাতের জন্য। কারণ, আমার প্লেন দুর্ঘটনায় পড়তে পারে। এখানে কি বিমান বিস্ফোরণ হয় না ? মানুষ কি প্রতি দিনই মারা যাচ্ছে না ?
এটা চিন্তা করা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর যে, আমি জাহান্নামে যাবো চিরকালের জন্য, আগুনে দগ্ধ হওয়া অনন্তকালের জন্য ! সুতরাং আমি যা করবো,(আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছে, আমি জবাব দিচ্ছি) আমি যখন অবসর নিবো, আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করবো মানুষকে সাহায্য করার জন্য। এই জন্যই আমি এখানে(ইংল্যান্ড) জনি ওয়াকার এর সাথে। একজন দরিদ্র মানুষ এসেছে, এখানে কতিপয় তরুণ যাদের অর্থের প্রয়োজন। আর কেউ আমাকে আহ্বান করছে তাদেরকে সাহায্য করার জন্য। সৃষ্টিকর্তা আমাকে দেখছেন। সৃষ্টিকর্তা আমার প্রশংসা এজন্য করেন না যে আমি জো ফ্রেইযারকে (আরেকজন বিখ্যাত বক্সার) হারিয়েছি। তাকে হারানোতে আল্লাহ কিছু দিবেন না। আমরা যতদূর জানি, ইংল্যান্ড বা আমেরিকাকে আল্লাহ গুরুত্ব দেন না। কারণ সবকিছুই তাঁর। তিনি দেখতে চান আমরা একে অপরের সাথে কেমন ব্যবহার করি, কিভাবে আমরা একে অপরকে সাহায্য করি। তাই, আমি আমার জীবনকে উৎসর্গ করতে চাই, আমার নাম এবং সুনামকে ব্যবহার করে দানশীলতায় সহায়তা করার জন্য, মানুষকে সহায়তা করার জন্য, মানুষের মাঝে ঐক্য ও সংহতি তৈরীর জন্য। মানুষ একে অপরকে বোমা মারছে ভুল ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে। পৃথিবীতে আমাদের এমন কাউকে দরকার শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য। তাই, আমি যদি মারা যাই, আর যদি জান্নাত থাকে, আমি তা দেখতে চাই। কারণ, আমরা কয় দিনইবা বঁাচি, ৮০ বছর ? এই রুমের প্রত্যেকেই, আপনাদের মধ্যে কেউ মারা যাবে ২০ বছর পরে, কেউ মারা যাকে ৫০ বছর পরে, কেউ মারা যাবে ৩০, ৬০ অথবা ৭০ বছর পরে। আমরা সবাই খুব শীঘ্রই মারা যাবো। আর, ধরে নিলাম, যদি আপনি বঁাচেন ১২৫ বছর, যা আসলে আমাদের পক্ষে সম্ভব না, তাই না ? ধরুন, আমরা বাচিঁ ২৫০ বছর, আর আপনি এর মধ্যে ইন্দ্রীয় সুখ উপভোগ করেছেন ১৪৫ বছর, এর পরেও সেই জীবনের অবসান হবে। সুতরাং, আমাদের এই পৃথিবীতে ৮০ বছরের মতো সময়ও নেই। এটা একটা পরীক্ষা তা দেখার জন্য যে কোথায় আমাদের পরিণতী হবে জান্নাত নাকি জাহান্নাম। এটাই প্রকৃত জীবন নয়। আপনার আসল সত্তা হলো আপনার ভিতরে, আপনার দেহ বৃদ্ধ হয়ে যায়। একসময় আপনি দেখবেন আপনার দঁাত নেই, আপনার চুল পড়ে যাচ্ছে, দেহ অবসন্ন হয়ে আসছে। কিন্তু আপনার আত্মা কখনো মরে না। এটা চিরকাল জীবিত থাকবে। সুতরাং আপনার দেহ শুধুমাত্র আপনার আত্মাকে বহন করছে।
সুতরাং, সৃষ্টিকর্তা আমাদের পরীক্ষা করছেন এটা দেখার জন্য যে, কিভাবে আমরা অন্যের সাথে আচরণ করি, জান্নাতে আমাদের প্রকৃত বাসস্থানের অধিকারী হতে পারি। সুতরাং, এই বস্তুগত উপকরণাদি বেশিদিন টিকে না। এই বিল্ডিং টিকে থাকা অবস্থাতেই এর নির্মাতা মানুষটি মারা যাবে। ইংল্যান্ডে আনেক রাজা-রাণী ছিলেন, তারা সবাই মারা গেছেন। একজনের পরে আরেকজন আসবে। সুতরাং, আমরা এখানে চিরকাল অবস্থান করবো না। আমরা শুধুমাত্র সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক, আমরা কোন কিছুর অধিকারী নই। এমনকি আপনার সন্তানরাও আপনার নয়। আপনি মনে করছেন আমি মিথ্যা বলছি ? আপনার স্ত্রী আসলে আপনার নয়। আপনি মারা যান আর এরপর একবছর পরে ফিরে এসে আপনার বেডরুমে ঘুমাতে যান আর দেখুন আপনার স্ত্রী কি আপনার থাকে কিনা। আপনি আপনার স্ত্রীর অধিকারী নন। আমি আমার স্ত্রীকে তালাক দিয়েছি, হয়তো আপনারা এ ব্যাপারে পড়েছেন। আমার চার সন্তান এখন অন্য আরেকজনকে বাবা ডাকে। তারা এখন আর আমাকে দেখে না। আপনি আপনার সন্তানদের অধিকারী নন। আপনি আপনার পরিবারের অধিকারী নন। তাই, আমি যা বলছি, জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূণর্ বিষয় হলো, কি ঘটবে আপনি যখন মারা যাবেন, আপনি কি জান্নাতে যাবেন নাকি জাহান্নামে। আর এটা হবে অনন্তকালের।
অনন্তকাল কি পরিমাণ সময় ? উদাহরণ হিসেবে সাহারা মরুভূমিকে নিতে পারেন। সাহারা মরুভূমিতে অনেক বালি তাই না ? ধরুন, একটা বালির কণা হলো ১০০০ হাজার বছরের প্রতীক। আর যখন আপনি জাহান্নামে দগ্ধ হবো, তা হবে চিরকালেন জন্য, চিরকাল এবং চিরকাল, কোন শেষ নেই। কত লম্বা সময় তা ? আপনাদেরকে একটা ধারণা দেই অনন্তকাল কত লম্বা। আমি আপনাদেরকে বলেছি সাহার মরুভূমির থেকে প্রতি ১০০০ বছরে একটা করে বালির কণা নিতে থাকুন যতক্ষণ না মরুভূমি খালি হয়ে যায়। ঠিক আছে, অপেক্ষা করুন ১০০০ বছর, তারপর একটি বালির কণা তুলে নিন। পরবর্তী কণা নেওয়ার আগে আরও ১০০০ বছর অপেক্ষা করুন। কণা তুলতে থাকুন যতক্ষণ না মরুভূমিতে আর কোন বালি না থাকে। আপনি জানেন এটা কত লম্বা সময় ? আমেরিকার বয়স ২০০ বছরও না। ১০০০ বছর পূর্ণ করতে আমাদেরকে আরও ৮০০ বছর পার করতে হবে। সুতরাং, এই চিন্তা আমাকে আতঙ্কিত করে যে, আমি একদিন মারা যাবো আর এরপর জাহান্নামে যাবো। আমি এরোপ্লেনে আছি আর এটা যেকোন সময় বিস্ফোরিত হতে পারে, আমি সবসময় ভ্রমণ করছি। সৃষ্টিকর্তা আমার বিচার করবেন। আমি মানুষ হত্যা করতে পারি, আমি ডাকাতি করতে পারি। প্রশাসন আমাকে নাও ধরতে পারে, এফ. বি. আই. স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডও হয়তো আমাকে নাও ধরতে পারে। কিন্তু যখন আমি মারা যাবো, কেউ একজন আমাকে দেখছেন এবং হিসাব রাখছেন আর আমি তা থেকে পালাতে পারবো / রেহাই পেতে পারবো না। আর আমি আগুনে দগ্ধ হতে চাই না চিরকাল, চিরকাল এবং চিরকালের জন্য, আমি জান্নাতে যাবো। তাই, আমি বক্সিং থেকে অবসরের পরে যা করবো, পরবর্তী ১৬ বছরের গঠনমূলক সময়ে আমি নিজেকে তৈরী করবো যাতে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য পেতে পারি এবং সর্বোত্তম স্থানে যেতে পারি। এটা কি যুক্তিসঙ্গত মনে হয় ?
Subscribe to:
Posts (Atom)